কক্সবাজার সুগন্ধা পয়েন্টে জায়গা দখল করে চলছে দোকান নির্মাণের কাজ

May 1, 2025 - 16:56
 0  2
কক্সবাজার সুগন্ধা পয়েন্টে জায়গা দখল করে চলছে দোকান নির্মাণের কাজ
ছবি : সংগৃহীত

আরিয়ান খান, কক্সবাজার প্রতিনিধি

দীর্ঘদিন ধরে চলছে নির্মাণকাজ। গড়ে তোলা হচ্ছে প্রায় একশ দোকান। অনেকটির কাজ শেষ পর্যায়ে। তবে সেখানে সাধারণ মানুষের যাওয়ার সুযোগ নেই। বিশাল জায়গাজুড়ে চারদিকে উঁচু টিনের বেড়া। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা কক্সবাজারের সাগরতীরে সরকারি জায়গায় চলছে এ দখলযজ্ঞ। রাজনৈতিক দলের পরিচয়ধারী একটি চক্র এজন্য তৈরি করে নিয়েছে ভুয়া দলিল। প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন দখলবাজি নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন।

সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে প্রবেশের সময় যে কারও নজরে পড়ে সবুজ রংয়ের একটি গেট। এতে লেখা ‘এই প্রতিষ্ঠান সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ দ্বারা নিষেধাজ্ঞা আছে। সংরক্ষিত এলাকা, উন্নয়নকাজ চলিতেছে। বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।’ সেখানে টিন দিয়ে ঘেরা ২ একর ৩০ শতাংশ জায়গা। প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের এ জায়গায় জোরেশোরে চলছে নির্মাণকাজ। জানা গেছে, একেকটি দোকানের আয়তন ৮০ বর্গফুট। ৮০ থেকে ১০০টি দোকানের কাজ চলছে।

সুগন্ধা পয়েন্টে এই হোটেল-মোটেল জোনে গত ৫ আগস্টের পর প্রথমে একটি পক্ষ জায়গা দখল করেছিল। সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে তাদের তাড়িয়ে দেন। পরে সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্তের পক্ষে হাইকোর্টের একটি নিষেধাজ্ঞার নোটিশ টাঙিয়ে আরেকটি পক্ষ নির্মাণকাজ শুরু করে। নির্মাণাধীন ঘরের ছবি কয়েকদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর শুরু হয়েছে তোলপাড়।

জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) বলছে, ঘিরে রাখা জমির পুরোটাই সরকারি। দখলবাজ চক্র ভুয়া কাগজ তৈরি করে এই জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন দেখিয়ে রাতারাতি মার্কেট নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নিজাম উদ্দিন আহমেদ যমুনা টাইমসকে বলেন, নির্মাণকাজ গত রোববার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নির্মিত স্থাপনাগুলো কয়েক দিনের মধ্যে সরিয়ে নিতে সোমবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তা না হলে অভিযান চালিয়ে ভেঙে দেওয়া হবে।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপনগর পরিকল্পনাবিদ মো. তানভীর হাসান রেজাউল বলেন, নির্মাণাধীন স্থাপনাগুলোর বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাদের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আইন অনুযায়ী যে কোনো স্থাপনা নির্মাণে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, কক্সবাজার জেলা শাখার সহসভাপতি ওবায়দুল হাসান এই জমি দখলে নিয়ে নির্মাণকাজ করাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দিয়ে কয়েক বছর ধরে সাগরপারের জমি দখল করে চলেছেন তিনি। এসব নিয়ে গত সরকারের সময় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষে অনেকবার সংঘর্ষ হয়েছে। এখন তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিএনপির একটি চক্র। ওবায়দুল হাসানের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় হামলা চালানো এবং ইউনিয়ন বিএনপি অফিসে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে মামলা আছে। তিনি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন কিছুদিন। তার পরও থেমে নেই দখল বাণিজ্য।

স্থানীয়রা বলছেন, তাঁর সঙ্গে বিএনপির লোকজন যুক্ত হওয়ায় প্রশাসন জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এ চক্রে রয়েছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত কক্সবাজার পৌরসভার একজন সাবেক কাউন্সিলর, কৃষক দলের একজন নেতা, দু’জন আইনজীবী। কক্সবাজার সদর ইউনিয়ন এবং উপজেলা ভূমি অফিসের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে দখলবাজ চক্রের যোগসূত্র রয়েছে বলে জানা গেছে।

জাল দলিল করে জমিটি দখলে নেওয়া হয়। জাল দলিলে স্বাক্ষর রয়েছে কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ উল্লাহ নিজামীর। তুলনাকারক হিসেবে ভূমি অফিসের নাজির মোহাম্মদ আলমগীর ও নকলকারক হিসেবে কর্মচারী মোহাম্মদ আয়াছের স্বাক্ষর আছে। আরিফ উল্লাহ বর্তমানে টেকনাফ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি)। তিনি যমুনা টাইমসকে বলেন, ‘আমার স্বাক্ষর জাল করে কয়েকটি খতিয়ান সৃজন করে একটি চক্র এই জায়গাটি দখল করেছে। তাদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।’

নাজির মোহাম্মদ আলমগীর দাবি করেছেন, জালিয়াতি করেই এ রকম খতিয়ানের সহিমুহুরি নকল সংগ্রহ করা হয়েছে। দখলবাজ চক্র সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্তের নামে তৈরি নকল খতিয়ানের কপি নিয়েই সরকারি সম্পত্তিটি হাতিয়ে নিতে তৎপর।

কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শারমিন সুলতানা বলেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নজরে আসার পর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভূমি অফিসের মূল রেকর্ডে সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত নামের কোনো ব্যক্তির খতিয়ানের অস্তিত্ব নেই। ভূমি অফিসের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে জায়গা ভাড়া নিয়ে দোকান নির্মাণ করছি। একটি রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দোকানগুলো উচ্ছেদ না করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে।’

ভুয়া দলিল সৃজনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কক্সবাজার সদর উপজেলা ভূমি অফিসের পক্ষ থেকে নাজির মোহাম্মদ আলমগীর ও নকলকারক আয়াছ কক্সবাজার সদর থানায় একটি অভিযোগ করেছেন। ভুয়া দলিল সৃজন করার অভিযোগে গত ১০ নভেম্বর দু’জনের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করা হয়। তাদের একজন সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত। তাঁর বর্তমান ঠিকানা কক্সবাজার পৌরসভার হাসপাতাল সড়ক এলাকায়। অন্যজন ঈদগাঁও উপজেলার পালাকাটার মো. শফিক।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, উপজেলা ভূমি অফিসের সিল, স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে চারটি বিএস খতিয়ান সৃজন করে সরকারি খাসজমি অবৈধভাবে দখল করার উদ্দেশ্যে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয় দখলকারীদের পক্ষ থেকে। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ছয় মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেন। এর কপি ভূমি অফিসে আসার পর ভুয়া খতিয়ানের বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত নামে যিনি রিটকারী, তাঁকে কেউ কখনও দেখেননি। তিনি মৃত না জীবিত, এর সঠিক তথ্য কেউ দিতে পারেননি। কিছু দখলবাজ নানা ফন্দি করে জায়গা দখলে নিতে চাচ্ছে।’

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow