পাবনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের রাজনৈতিক গ্রুপিং, সেবা বঞ্চিত আরোগ্য প্রত্যাশীরা!

Jul 28, 2025 - 02:30
Jul 28, 2025 - 02:31
 0  4
পাবনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের রাজনৈতিক গ্রুপিং, সেবা বঞ্চিত আরোগ্য প্রত্যাশীরা!
ছবি : যমুনা টাইমস

আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, পাবনা

২০০ বছরের পুরোনো স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট পাবনা জেনারেল হাসপাতালে সমস্যাই বেশি দেখা দিয়েছে। হ্রাস পেয়েছে সম্ভাবনা। জেলার দুরদুরান্ত থেকে আসা রোগীরা কাঙ্খিত সেবা থেকে হচ্ছেন বঞ্চিত।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা এই স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে প্যাথলজি পরীক্ষার সুযোগ থাকলেও উপকরণ সংকটে সেবা পান মাত্র ২০ শতাংশ রোগী। মেলে না বিনামূল্যের ওষুধও। আইসিইউ ইউনিট ২০১৬ সালে হাসপাতালের পুরাতন ভবনের দোতলায়  উদ্বোধন করা হলেও প্রয়োজনীয় লোকবল ও সংযোজক যন্ত্রাংশ না থাকায় তা আজও চালু করা সম্ভব হয়নি। হৃদরোগীদের জন্য ২০ শয্যার সিসিইউ ইউনিট চালু থাকলেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় সেবা দেয়া যায় ৮ জন রোগীকে। কারিগরি সুবিধা না থাকায় অকার্যকর পোস্ট অপারেটিভ ইউনিট। সরেজমিনে হাসপাতাল ঘুরে, রোগী, রোগীর স্বজন, হাসপাতাল সংশ্লিষ্টসহ নানা সোর্সের মাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
 
পাবনা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. জাহিদুল ইসলাম বলেন, আইসিইউ পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি থাকলেও সেগুলো সংযোজনের প্রয়োজনীয় অনেক সরঞ্জাম আমাদের নেই। অতিরিক্ত রোগীর চাপের কারণে সিসিইউ ইউনিটে ২০ শয্যা আমরা সম্প্রসারণ করেছি। কিন্তু মনিটরসহ অনেক যন্ত্রাংশ না থাকায় তার সুফল মিলছে না। অনেক যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে, বরাদ্দ সংকটে তা নতুন করে কেনা সম্ভব হয়নি।

হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সিরাজুল ইসলাম জানান, আইসিইউ পরিচালনায় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীসহ সেরকম দক্ষ জনবল আমরা কখনোই বরাদ্দ পাইনি। নাম কাওয়াস্তে আইসিইউ উদ্বোধন হলেও তা কখনোই চালু করা যায়নি। আমাদের হাসপাতালে পোস্ট অপারেটিভ ইউনিটই তো নেই। দক্ষ জনবল, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অভাবে অপারেশনের সময় নানা সমস্যায় পড়েন চিকিৎসকরা। এমনকি বিদ্যুৎ চলে গেলে অপারেশন বন্ধ করে বসে থাকতে হয়। জেনারেটর অকেজো। স্পর্শকাতর এ বিষয়গুলোর দ্রæত সমাধান জরুরী।
 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসায় রোগ নির্ণয়ে হাসপাতালে অত্যাধুনিক সিটি স্ক্যান ও এক্সরে মেশিন থাকার পরেও ফিল্ম সংকটে বছরের অধিকাংশ সময়ই তা থাকে বন্ধ। ফলে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণসহ গুরুতর রোগীদের পরীক্ষায় সময়ক্ষেপণ ও বাড়তি অর্থ খরচে বাইরে যেতে হয়। গুরুতর রোগীকে ঢাকা রাজশাহী নিতে ভোগান্তিতে পড়েন রোগীরা।

পাবনা সদর উপজেলার ভাঁড়ারা গ্রাম থেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সত্তর বছরের রোগী আব্দুস সালাম বলেন, পেটে ব্যাথার চিকিৎসার জন্য মাত্র একটি পরীক্ষা হাসপাতাল থেকে করা সম্ভব হয়েছে। ওষুধও পাইনি। কম পয়সার জন্য সরকারি হাসপাতালে এসে সবই যদি বাইরে থেকে নিতে হয় তা হলে হাসপাতাল থেকে লাভ কি? আটঘরিয়া থেকে আসা রোগীর স্বজন আবুল কালাম বলেন, গুরুতর রোগী নিয়ে হাসপাতালে এলেই ঢাকা কিংবা রাজশাহী রেফার্ড করা হয়। এর একটা প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন।

পাবনা সদরের মনোহরপুর গ্রামের জুয়েল আহমেদ বলেন, মাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। যে ডাক্তার অপারেশন করবেন তিনি করেননি। হাসপাতালে অপারেশন না করিয়ে ডাক্তারদের নিজস্ব হাসপাতালে অপারেশন করানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু আমাকে তাদের হাসপাতালে তাদের কোন দালাল নিতে পারেননি। 

আব্দুল আলীম নামের আরেক রোগীর স্বজন বলেন, হাসপাতাল আর হাসপাতাল নেই। নোংড়া, অপরিস্কার, বৈদ্যুতিক লাইনে সমস্যা, ফ্যান অকেজো, বাথরুমগুলো অপরিস্কার, দালালদের ভরপুর, রোগীদের সাথে চিকিৎসা প্রদানকারী সেবিকা ও জুনিয়র চিকিৎসকদের দূর্ব্যবহারসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। 

হাসপাতাল ঘুরে তথ্যানুসন্ধানে পাওয়া যায়, স্বৈরাচার সরকার পতন অর্থাৎ ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপি, জামায়াত ও আওয়ামীলীগ পন্থী চিকিৎসক ও চিকিৎসক সংগঠনের মধ্যে দেখা দিয়েছে আধিপত্য বিস্তার ও মতানৈক্য। অর্থপেডিক্স বিভাগের জনৈক চিকিৎসক নিজেকে অঘোষিত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হিসেবে দাবী শুরু করে দাপট ও প্রভাব বিস্তার করেছেন। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন চিকিৎসক বলেন, টাকা নিয়ে ও বিএনপি-জামায়াতের প্রভাব খাটিয়ে বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে এই হাসপাতাল থেকে বদলী করা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে সিনিয়রদের সরিয়ে জুনিয়র চিকিৎসকদের বদলী করে আনা হয়েছে এই হাসপাতালে। চলছে রাজনৈতিক গ্রুপিং। তাদের মতে অসহায় হয়ে পড়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। 

তথ্যমতে, এখনও স্বাচিপের কয়েকজন নেতা বহাল তবিয়তে এই হাসপাতালে প্রভাব ও দাপট বিস্তার অব্যাহত রেখেছেন। ড্যাবের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকলেও শীর্ষ দুই চিকিৎসক নেতা বদলী বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মতান্ত্রিক কাজ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিক রং মাখিয়ে অনেক চিকিৎসক হাসপাতালে নির্ধারিত সময় উপস্থিত না থেকে বাইরের বিভিন্ন ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট প্রাকটিসে সময় দেন বলে জানা যায়। 

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মুঠোফোনে পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. রফিকুল হাসান রুমন বলেন, প্রয়োজনীয় বরাদ্দের অভাবে আর্থিক সীমাবদ্ধতায় সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রত্যাশিত সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের এই হাসপাতাল ২৫০ শয্যার হলেও, প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার রোগী এ হাসপাতালে বর্হিবিভাগ ও অন্তঃবিভাগ মিলিয়ে চিকিৎসার জন্য ভিড় করেন। পরীক্ষা উপকরণ, ওষুধ ক্রয়ে আমরা যে বরাদ্দ পাই তাতে কেনা উপকরণ বছরের দুই মাস না যেতেই শেষ হয়ে যায়। বাধ্য হয়েই আমাদের রোগীদের ফিরিয়ে দিতে হয় বা পরীক্ষা বন্ধ রাখতে হয়। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করছি দ্রুতই এ বিষয়ে একটা সমাধান হবে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow