অন্ধকারে আলোর যাত্রা: পাবনার হরিজন কলোনীর জীবনের গল্প

আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী
ঘড়িতে তখন সকাল ৮: ৩০ মিনিট। একজন ডেলেবারি বয় কোনো এক বাসার কোলিং বেল চাপলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে একটি মেয়ে দরজা খুললেন। বসন তার যথেষ্ট মার্জিত। ছেলেটিকে দেখে বললেন, ও তুমি এসেছো, একটু দাঁড়াও। একথা বলেই তার মাকে ডেকে বলেলেন, মা, পার্সেলটা রিসিভ করো তো। আমার অফিস টাইম হয়ে যাচ্ছে, আমি গেলাম। তারপর ছেলেটিকে পাশ কাটিয়ে রওনা হলো অফিসের উদ্দেশ্যে।
সুপ্রিয় পাঠক, এতক্ষণ আমি যার কথা বললাম, সে কিন্তু হরিজন সম্প্রদায়ের একটি মেয়ে। নাম লতা। পড়াশোনা করেছে পাবনার ঐতিহ্যবাহী সরকারি এক প্রতিষ্ঠান থেকে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করে করছেন একটি ভালো চাকুরী। সত্যিই ভাবতে খুব ভালো লাগছে, তাই না। এই পরিবর্তন যে এক আশার আলো, অন্ধকার দূরীভূত করার উজ্জ্বল ইঙ্গিত, তা একেবারে নিঃসন্দেহে বলা যায়।
প্রিয় পাঠক, এবার বলি হরিজনদের দুঃখগাথা-
মিনতি রানী, ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এসেছিলেন স্বামীর সংসারে। বর্তমানে তার বয়স ৬৪ বছর। স্বামী মারা গেছেন অনেক আগেই। ছেলে ও মেয়ের সাথে বসবাস। বর্তমানে পরিবারে ৭ সদস্য। সংসার দেখভাল করছেন একমাত্র ছেলে। ছেলেটির নির্দিষ্ট কোন কর্ম নেই। গ্রামগঞ্জে বালতি সার্ভিস দিয়ে কোনমতো সংসার চলছে। নেই বাড়তি ইনকাম। পাননা সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা। তাই খুব কষ্টেই চলছে তাদের সংসার। আজ ৬৪ বছরের এই মিনতি রানী খুব ভালো নেই বলেই অনুমিত হয়। প্রতিদিন গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে থাকেন কলোনীর সামনে মন্দিরের পাশে। একরাশ চিন্তার ভাজ যেন তার কপালের রেখা সজাগ হয়ে আছে। দিন যতই যাচ্ছে ততই তিনি বয়সের ভারে নুব্জ হয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবেদককে বার বার বলছিলেন, আমার জীবন তো শেষ পর্যায়ে। আমার ছেলে-বউ-নাতিপুতির কি হবে? কিভাবে চলবে তাদের সংসার পরিবার পরিজন?
শহরের আলো ফুটে ওঠার আগেই যখন অন্ধকারে থাকা এই মানুষগুলোর পদাচারণায় পাবনা শহরের ঘুম ভাঙে, রাস্তাগুলো ঝকঝকে, নর্দমা পরিষ্কার, হাসপাতালের করিডোরে জমে থাকা ময়লা সবই কোনো অজানা হাতের স্পর্শে নির্দিষ্ট ভাগাড়ে চলে যায়। এই হাতগুলোই হরিজন সম্প্রদায়ের। যারা নোংরা পরিষ্কার করে শহরকে সুন্দর রাখে, অথচ নিজের জীবনের ময়লা কেউ পরিষ্কার করে-না। তাদের জীবন যেন শহরের পরিষ্কার রাস্তার ছায়া চকচকে, কিন্তু ভেতরে ঘাম ও ধুলোর স্তর। তাদের মুখে হাসি আছে, কিন্তু সেই হাসির ভিতর লুকিয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা কষ্ট, অবহেলা আর অভিমান।
পেছনের গল্প :
৪৭ বছরের পুরোনো পাবনার দক্ষিণ রামচন্দ্রপুর হরিজন কলোনী। শহরের অনন্ত বাজার ঘেঁষে দক্ষিণ রামচন্দ্রপুর এই পৌর কলোনীর অবস্থান। ১৯৭৮ সালের দিকে সরকার ৮১টি পরিবারের জন্য তৈরি করেছিল ৮১টি ঘর। একটি বড় বাউন্ডারির ভেতরে। সময় গড়িয়েছে প্রায় অর্ধশতাব্দীরও অধিক। এখন সেখানে ২৫০টি পরিবারের বসবাস, মানুষ প্রায় দুই হাজারেরও বেশি। এক কক্ষেই একাধিক পরিবার। বারান্দা, রান্নাঘর, এমনকি ঘরের কোণা সর্বত্রই এখন ঘুমানোর জায়গা। একটি ঘরে গাদাগাদি করে থাকে কখনো ১০/১২ জন মানুষ। দরজার পাশে শিশুরা খেলছে, রান্নাঘরের পাশে কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ আবার কাপড় শুকাচ্ছে মাথার ওপরে ঝুলন্ত দড়িতে।
মায়ারানি দাস, হরিজন কলোনীর ৬৫ বছরের একজন প্রবীণ নারী। ভাঙা বারান্দার পাশে বসে বললেন, “এই ঘরেই বউ হয়ে এসেছিলাম, এখন ছেলের বউ, নাতি, সবাই এই এক ঘরে (একাধিক খোপ সদৃশ)। জায়গা নেই, কিন্তু যাওয়ারও জায়গা নেই।” তার কণ্ঠে কাতরতা, তবুও একটুখানি গর্ব “আমরা ময়লা পরিষ্কার করি, তাই শহরটা সুন্দর। কিন্তু কেউ আমাদের দিকে তাকায় না। আমাদের ঘরটা দেখলেও বোঝা যেত আমরা মানুষ।”
জীবনযাত্রার কষ্ট :
আলো নেই, পানি নেই, আশ্বাস ছাড়া কিছুই নেই। কলোনীতে গিয়ে চোখে পড়ে ভাঙা ছাদ, জীর্ণ দেয়াল, পানি পড়ছে ছাদের ফাটল দিয়ে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই, বর্ষায় জলাবদ্ধতা, দুর্গন্ধযুক্ত, রোগব্যাধি সব একসাথে যেন বাসা বেঁধে আছে। পুরো কলোনীর ২০০০ মানুষের জন্য আছে মাত্র ৬টি টয়লেট। তাতেও পয়ঃনিষ্কাশনের তেমন ব্যবস্থা নেই।
৫০ বছরের গীতা দাস বলেন, “সকালে বাথরুমে যাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়। কখনো বাচ্চা কাঁদে, কখনো রোগী অপেক্ষা করে। আমরা মানুষ, কিন্তু আমাদের জীবন যেন বাইরে বসবাসরত প্রাণীর মতো।”
'বিকাশ' নামে একটি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র একসময় শিশুদের অক্ষরজ্ঞান দিত। এখন তা বন্ধ অর্থের অভাবে। তারপরও থেমে নেই শিশুদের শিক্ষাদান। শহরের আশপাশে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক অক্ষর জ্ঞান গ্রহণ করছে।
একজন তরুণ, রাঙা কুমার দাস, পৌরসভায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী। বললেন, “আমরা দিনরাত কাজ করি। শহর পরিষ্কার রাখি। অথচ আমাদের নিজের কলোনীতে পানি আসে না, ড্রেন পরিষ্কার হয় না। আমাদেরও তো মানুষ মনে করা উচিত।”
সমাজের চোখে তারা এখনো ‘অন্য’ হরিজন শব্দটির অর্থই যেন হয়ে গেছে সামাজিক প্রাচীর। একই দেশে থেকেও তারা আলাদা এক পৃথিবীতে বাস করে। তাদের সন্তানরা স্কুলে যায় ঠিকই, কিন্তু কখনো সহপাঠীর পাশে বসতে দেয় না কেউ। অনেক সময় পানির কল ভাগ করে নিতে চায় না অন্য পরিবারগুলো। “তুমি তো ওই কলোনীর মানুষ!” এই একটি বাক্যই ভেঙে দেয় তাদের শিশুর আত্মসম্মান।
একজন কলেজ পড়ুয়া তরুণী শিবা দাস বলেন, “আমরা পড়াশোনা করছি, কিন্তু সমাজ এখনো আমাদের চোখে ‘সুইপার’ই দেখে। আমি চাই একদিন সবাই বলুক, আমিও মানুষ, শুধু হরিজন না।”
এক কক্ষের ভেতর বহু প্রাণ: হরিজন কলোনীর আবাসনের করুণ বাস্তবতা :
বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদ পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শ্রী কবিরাজ হাড়ী জানালেন, ৪৭ বছর আগে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাবনা পৌর সুইপার কলোনীর ৮১ পরিবারের জন্য নির্মিত হয়েছিল ৮১টি পাকা ঘর, ব্যারাকের মতো করে। আজ সেই জায়গায় বসবাস করছে প্রায় ২৫০টি পরিবার, সদস্য সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি। একেকটি পরিবারের জন্য বরাদ্দ কতটুকু তা নিশ্চয় সবাই অনুমান করা যায়। সেই বরাদ্দকৃত ঘরের মধ্যেই তৈরি হয় ২/৩টি পাটিশন, রান্নাঘরেই বিছানা পেতে রাত কাটাতে হয় অনেককে। আবার অনেক সময় পালাবদল করেও ঘুমানো/বিশ্রাম করা হয়। বারান্দাও শোবার ঘর, ছাদ হয় কাপড় শুকানোর জায়গা। অনেকের জায়গা সংকুলান না হওয়ায় আবার ছাদের ওপরে ঘর (খোপ সদৃশ) করেছে। আর্থিক সংকটে ভাড়া বাসায় থাকা অসম্ভব, তবুও প্রায় ৩০ শতাংশ পরিবার বাধ্য হয়ে শহরের প্রান্তে আশ্রয় নেয়। কবিরাজ হাড়ীর কণ্ঠে অভাবের দীর্ঘশ্বাস “আমাদের ঘর ছোট, মানুষ অনেক। জায়গা নেই, কিন্তু বাঁচার ইচ্ছে এখনো থেমে থাকে না যা মানুষের চিরাচরিত।”
কর্মজীবন :
পরিচ্ছন্ন শহরের নোংরা বাস্তবতা পাবনা পৌরসভায় বর্তমানে প্রায় ৩৫০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী, তাদের বেশিরভাগই এই কলোনীর। ভোর পাঁচটা থেকে শুরু হয় তাদের দিন। রাস্তায় ঝাড়ু, নর্দমায় হাত, বর্জ্য বহন সবকিছু করে তারা। দিন শেষে মজুরি হাতে আসে অল্প কয়েকশো টাকা।
৫০ বছরের পরেশ দাস বললেন, “আমরা কাজ না করলে শহর থেমে যাবে, কিন্তু কাজ করেও আমাদের পেট চলে না। শহরে জ্বলে আলো, আমরা বাঁচি অন্ধকারে (সুবিধাবঞ্চিত)।”
আরেকজন প্রবীণ, শান্তি রানি, ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, “আমাদের কোনো ছুটি নেই। বৃষ্টি এলেও কাজ করতে হয়। রেইনকোট পাই না, ছাতা পাই না। উৎসবের বোনাসও বেতনের টাকা কেটে দেয়।” তাদের মুখে অপরিসীম তিক্ততা, মনে দুঃখের পসরা কিন্তু দৃষ্টিতে এখনো আশার রেখা। তারা অভ্যস্ত কষ্টে, কিন্তু মানেনি পরাজয়।
গীতা দাসের প্রশ্ন: “আমরা মানুষের ঘর পরিষ্কার রাখি, আমাদের ঘর এত মলিন কেন?” কলোনীর ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে এক নিঃশব্দ মুখ ৬৫ বছরের মায়ারানী দাস, মৃত রনজিত দাসের স্ত্রী। ভাঙা চৌকির পাশে বসে বললেন, “ছেলেদের সংসারে জায়গা নেই, বয়স হয়েছে, কাজও করতে পারি না। দিন চলে অভাবে, রাতে ক্ষুধায় ঘুম আসে না।” তার পাশে বসে ছিলেন ৫০ বছরের সন্ধ্যা দাস, মৃত রাজের স্ত্রী। তিনি প্রতিবন্ধী, তবু হাসার চেষ্টা করেন। বললেন, “সরকারি সাহায্যের নামে আসে তালিকা, কিন্তু আমাদের নাম থাকে না। দারিদ্র্য এখন আমাদের নিত্য দিনের সঙ্গী ।” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ৭০ বছরের শান্তি দাস। তিনি বললেন, “আমরা তো মানুষের ময়লা পরিষ্কার করি, শহরকে সুন্দর রাখি। তাহলে আমাদের জীবন এত নোংরা কেন?” তাদের কণ্ঠে যা ছিল তা অভিযোগ না বলে বরং এক অব্যক্ত দীর্ঘশ্বাস একটি জাতির নিভৃত থাকা বেদনার প্রতিচ্ছবি।
পরেশ দাসের দিন: ঘুরে ঘুরে ফেরে অন্ধকারে। ৫০ বছরের পরেশ দাস প্রতিদিন ভোরে হাতে ঝুড়ি, কাঁধে সাইকেল নিয়ে বের হন কাজের খোঁজে। কখনো শহরের বাইরে, কখনো গ্রামে। কিন্তু প্রতিদিন কাজ মেলে না। বললেন, “কাজ না পেলে দুপুরে কিছু খাওয়া হয় না। তারপরও কারো ঘরের টয়লেট পরিষ্কার করি, কেউ কেউ দেন কেউ বা না দেয়ার চেষ্টাও করেন। তার চোখে একধরনের নীরব প্রতিবাদ, যেন বলতে চায়, “আমরা শহরের দুর্গন্ধ দূর করি, কিন্তু আমাদের জীবনের দুর্গন্ধকে দূর করবে কে?”
কান্তুয়া দাস ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, “রাগে নয়, কষ্টে মদ খাই” ৬৫ বছরের কান্তুয়া দা ও ৫০ বছরের জীবন দাস একসাথে বসেছিলেন কলোনীর এক কোণে। দিনের শেষে দু’জনেই ক্লান্ত। তারা বলেন, “সারাদিন কাজের খোঁজে ঘুরি, পয়সা পাই না। দেনা করে কখনো একটা বোতল আনি, রাগে খাই। এটা সুখের জন্য না, কষ্ট ভুলে থাকার জন্য।” তাদের পাশে বসে থাকা ৬৫ বছরের শিবুয়া দাস। চুপচাপ বললেন, “আমরা মদে ডুবে যাই না, আমরা ডুবে যাই অবহেলায়।” তাদের কথার মাঝে এক গভীর ব্যথা যেন শত বছরের উপেক্ষা, প্রজন্মের দুঃখ আর একটুখানি মর্যাদার আকুতি মিশে আছে প্রতিটি নিশ্বাসে।
৬৫ বছরের মিনতি বলেন, দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে গেছি। বয়স প্রায় শেষ। বিয়ে সুবাদে এই পল্লীতে আসা। স্বাস্থ্য কার্ড কাকে বলে, রেশন কার্ড কাকে বলেন, সরকারি অনুদান কি?, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার কার্ড কি জানিনা। কোনদিন দেখলাম না স্বাস্থ্য কর্মী আপা এই পল্লীতে এসেছেন। আমাদের স্বাস্থ্য চিকিৎসা দিয়েছেন।
মদের গল্প: আসক্তি না প্রতিরোধ?
কলোনীতে গিয়ে দেখা গেল, কিছু পুরুষ সন্ধ্যার পর একত্র হয়। কেউ গ্লাসে ঢালছে স্বচ্ছ তরল মদ। তাদের কাছে এটা আসক্তি নয়, অভ্যাস। ৬০ বছরের কান্তুয়া দাস বলেন, “দিনভর মল-মূত্র পরিষ্কার করি। গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে যায়। কাজ শেষে এক চুমুক না খেলে ভাত গলায় নামে না।” তাদের কথায় আছে বেদনার বাস্তবতা, “আমরা মদে ভাসি না, আমরা কষ্টে ভাসি। মদ শুধু ভুলিয়ে রাখে কিছু সময়ের জন্য।”
শিক্ষার আলো জ্বলছে ধীরে ধীরে :
কলোনীতে এখন প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু স্কুলে যায়। ইমাম গাজ্জালী গার্লস স্কুল, জেলা স্কুল, সেন্ট্রাল গার্লস হাই স্কুলসহ আশেপাশের প্রতিষ্ঠানে পড়ছে তারা। ইতোমধ্যে ২০ জন এসএসসি পাস করেছে যা একসময় ছিল অকল্পনীয়।
বিজয় কুমার দাস, হরিজন ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি, বলেন, “শিক্ষাই একমাত্র মুক্তি। কিন্তু টাকার অভাবে কত মেধাবী ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া মাঝপথে থেমে যায়। তবুও তারা স্বপ্ন দেখে, প্রত্যাশা করে একদিন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে এই কলোনী, বদলে যাবে আমাদের জীবন যাত্রা।”
পেশাগত পরিবর্তন আর শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে হরিজন সম্প্রদায়ের নেতারা কথা বলতে নারাজ। কলোনীতে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে যে বিষয়টি উঠে আসে তা হলো, পেশা পরিবর্তন, ক্রমেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে তাদের জনগোষ্ঠী এমন প্রচারে নেতারা তেমন উৎসাহবোধ করেন না । কারণ পেশার পরিবর্তন আর শিক্ষাদীক্ষায় হরিজন পরিবারের সদস্যরা এগিয়ে গেলে তাদের নেতৃত্বে নামবে ভাঁটা এমনটাই কেউ কেউ মনে করেন । হরিজন সম্প্রদায়ের ইতোমধ্যে বেশ কিছু ছেলে মেয়ে শিক্ষাদীক্ষায় অনেকটা এগিয়েছে। কেউ পুলিশে চাকরি করে, কেউ বা কর্পোরেট জবও করছেন।
আশ্বাসে ভর করে বেঁচে থাকা :
প্রতিবার নির্বাচনের আগে কলোনীতে আসে আশ্বাসের বন্যা। নতুন ঘর হবে, পানি আসবে, ড্রেন হবে, কর্মসংস্থান হবে, কিন্তু ভোটের পর সবই মিলিয়ে যায়, তাদের ভাগ্যে আসে না দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন।
সুবল দাস, হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,“আমরা ৪৭ বছর ধরে শুধু আশ্বাস শুনছি। এবার আমরা বাস্তব চাই। আমাদের মাথার ওপরে একটা ঠিকঠাক ছাদ চাই।”
পাবনা জেলা প্রশাসক মফিজুল ইসলাম বলেন, “হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য আবাসন প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে কাজ শুরু হবে।”
প্রশাসকের কথায় তারা বলেন, কিন্তু এই “হবে” শব্দটি তাদের কানে এখন ক্লান্তির মতো শোনায়। কারণ ৫০ বছর ধরে তারা শুনছে “হবে” কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।
হরিজন কলোনীর কয়েকজন পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সাথে আলাপকালে তাদের অভিমত, রোদ বৃষ্টি, রাতদিন, সময়-অসময় উপেক্ষা করেই আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমাদের খোঁজ স্বয়ং পৌরসভাই নেয় না।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, বৃষ্টিতে নেই ছাতা, নেই রেইনকোর্ট। রাতে কাজ করতে বাড়ি ফিরতে নিরাপত্তার জন্য নেই টর্সলাইট, নেই পৌরসভার মনোগ্রাম সম্বলিত কোন ইউনিফর্ম। করুণ সুরেই নাম প্রকাশ করতে অনুরোধ করে বলেন, আমাদের কলোনীতে পূজা ছাড়া নেই কোন সরকারি বরাদ্দ। বোনাস বলে যে টাকাটা দেয়া হয়। প্রত্যেক মাসে বেতন থেকে তার ১০০ টাকা করে কেটে নেয়া হয়। তাহলে বোনাস বলতে কি বোঝাচ্ছেন পৌরসভা কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় পাবনা পৌরসভার প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) জাহাঙ্গীর আলমের সাথে। অভিযোগ গুলো শুনে তিনি বললেন, আসলে এ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই। আর না জেনে তো কিছু বলতেও পারিনা। তিনি পৌরসভা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন অন্য কারও কাছ থেকে জানার জন্য পরামর্শ দেন। কিন্তু এ প্রতিবেদন তৈরীর সময়ে কয়েক দফা খোঁজ নিয়েও কারও বক্তব্য নেয়া যায়নি।
আলোয় ভেজা আশা :
প্রজন্ম বদলে দিচ্ছে গল্প সব অন্ধকারের মধ্যেও কিছু আলো আছে। কেউ পুলিশে চাকরি করছে, কেউ কর্পোরেট অফিসে। তারা প্রমাণ করছে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সন্তান মানেই এখন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নয়।
একজন তরুণ বললেন, “আমরা শহর পরিষ্কার করি, কিন্তু আমাদের স্বপ্ন মলিন নয়। আমরা চাই সন্তানরা ঝাড়ু নয়, বই হাতে তুলে নিক।” তাদের কণ্ঠে দৃঢ়তা, চোখে আশার দীপ্তি। তাদের কাছে স্বপ্ন কোনো বিলাসিতা নয়, বরং বেঁচে থাকার একমাত্র হাতিয়ার।
অবহেলা থেকে মর্যাদায় হরিজন সম্প্রদায় শুধু একটি পেশা নয়, এটি এক সংগ্রামের নাম, অস্তিত্বের লড়াই। তারা শহরের পেছনের চাকা, যাদের শ্রমে-ঘামে প্রতিদিনের জীবন এগিয়ে চলে। “তারা শহরের ধুলো মুছে দেয়, অথচ তাদের জীবনে জমে থাকা ধুলা কেউ মুছে না।” এই সমাজ যদি সত্যিই আলোকিত হতে চায়, তাহলে সেই আলো পৌঁছাতে হবে দক্ষিণ রামচন্দ্রপুরের অন্ধকার ঘরে ঘরে। কারণ মানবতার আলো তখনই পূর্ণ হয়, যখন সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষটিও সেই আলোয় আলোকিত হয়।
পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক আখতারুজ্জামান আখতার বলেন, সমস্যা চিহ্নিত করে সেটা জিইয়ে না রেখে দ্রুত সমাধান করাটা এখন জরুরী।প্রান্তিক নারী, দলিত, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ট্রান্সজেন্ডার, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সমস্যার কিন্তু শেষ নেই। কিন্তু নেই বাস্তব উদ্যোগ। সরকার, জনপ্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের শুধু আশ্বাসের বাণীতে এই সম্প্রদায়গুলো নিদারুন কষ্টে জীবন-জীবিকা, সংসার ও পরিবার পরিচালনা করছেন। এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হলে বাস্তবিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী। এই সমাজ পরিবর্তনে তাদের কিন্তু অংশীদারিত্ব রয়েছে। সেটাকে মাথায় রাখতে হবে। পাশাপাশি তাদের কল্যাণে সরকারি ভাবেই আইনগত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। যে আইন হবে তাদের অধিকার ও কল্যাণের পথ প্রসারিত হওয়া। আমাদের দেশের জনসংখ্যার মূল ধারায় তাদের ফিরিয়ে এনে তাদের যথাযথ মূল্যায়ণ করতে হবে। এটা করা গেলে তাদের অনেকাংশের সমস্যাগুলো পূরণ হবে।
সরেজমিনে ঘুরে হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষদের সাথে কথা বলে জানা গেল, সরকারি বেসরকারি নানা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থাকলেও তারা অনেক কিছুতেই অজানা। অভিযোগ আর অনুযোগে বারবার আবাসন আর কর্মসংস্থানের বিষয়টি বেশ নাড়া দিচ্ছে। অভাবই তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মে বড় বাধার কারণ। স্বাভাবিক জীবন যাপনে তাদের অনেক চাহিদা। কিন্তু চাহিদা মেটানো বড্ড সংকুচিত ব্যাপার। সরকারের সুযোগ সুবিধাগুলো নিশ্চিত করা যেমন জরুরী। তেমনই বেসরকারি পর্যায়ে তাদের সম্মুখ জ্ঞান দিতে জিও-এনজিও প্রতিনিধিদের তাদের দুয়ারে যাওয়াটা খুবই জরুরী। সরকারের জনগনের জন্য যে স্বদিচ্ছা রয়েছে। সেটা বাস্তবায়িত হলে অবশ্যই এই সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর মানুষ অনেকটাই উপকৃত হবেন।
Expanding civic space through active CSO participation and strengthened governance system in Bangladesh (ECSAP) নামে একটি প্রকল্প ক্রিশ্চিয়ান এইড, আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন সম্মিলিত ভাবে বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মূলতঃ বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন প্রান্তিক নারী, দলিত, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ট্রান্সজেন্ডার, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাথে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে যাতে করে এই জনগোষ্ঠীসমূহ তাদের অধিকার সঠিকভাবে ভোগ করতে পারে। প্রকল্পটি রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা ও ঢাকা জেলায় বাস্তবায়িত হবে।
What's Your Reaction?






