গোপালগঞ্জে এনসিপির সভাস্থল হামলা, ৩ মামলায় আসামি ২৬০০, গ্রেপ্তার ১৬৭

Jul 19, 2025 - 14:49
 0  3
গোপালগঞ্জে এনসিপির সভাস্থল হামলা, ৩ মামলায় আসামি ২৬০০, গ্রেপ্তার ১৬৭
ছবি : সংগৃহীত

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশস্থল ও নেতাদের গাড়িবহরে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হামলার ঘটনায় গত দু’দিনে করা তিনটি মামলায় ২ হাজার ৬০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। একই সময়ে অন্তত ১৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করার তথ্য নিশ্চিত করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে ৪৮ জনকে গতকাল শুক্রবার সদর থানায় করা একটি মামলায় প্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আটক হওয়া অনেকের খোঁজে তাদের স্বজন গতকাল শুক্রবার সদর থানার সামনে ভিড় জমান। এর মধ্যে ছয়টি পরিবার দাবি করেছে, তাদের ‘শিশু সন্তান’কে ধরে আনা হয়েছে। আটক অন্যদের বেশির ভাগই তরুণ-যুবা। কেউ কারখানার শ্রমিক, কেউ রিকশাচালক, কেউ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের কাজ করেন। সবার স্বজনই দাবি করেছেন, তাদের স্বামী-সন্তানরা নির্দোষ। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন।

গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অভিযান) ড. রুহুল আমিন সরকার বলেন, সন্দেহভাজন হিসেবে আটকদের তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। অপরাধসংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত হলেই কেবল তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে।

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশস্থল ও নেতাদের গাড়িবহরে আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হামলার ঘটনায় গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত চারটি মামলা হয়েছে। আরও একটি মামলার প্রস্তুতি চলছে। ওই দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের সময় গুলিতে চারজন নিহত হন। আহত একজন বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল পাঁচ। নিহতরা সবাই বয়সে তরুণ।

বুধবার রাত ৮টা থেকে এই জেলা শহরে কারফিউ চলছে। গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের সময় কারফিউ কয়েক ঘণ্টার জন্য শিথিল করা হয়। আবার কারফিউ বলবৎ হলে শহরে জনশূন্য হয়ে পড়ে। শহরের ছোট-বড় রাস্তাগুলো ছিল যানবাহনশূন্য।  

পুলিশের গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় মামলা

পুলিশ জানিয়েছে, তিন মামলায় এবং সন্দেহভাজন হিসেবে ৫৪ ধারায় জেলায় মোট ১৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ সদর থানায় ৪৮, মুকসুদপুর থানায় ৬৬, কাশিয়ানী থানায় ২৪, টুঙ্গিপাড়া থানায় ১৭ ও কোটালীপাড়া থানায় ১২ জন। সংশ্লিষ্ট থানার ওসিরা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় সদর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহম্মেদ আলী বাদী হয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি নিউটন মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক আতাউর পিয়ালসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলাটি করেন। এতে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৪৫০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি জানান, এনসিপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বুধবার গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট আঞ্চলিক সড়কের সদর উপজেলার উলপুরে পুলিশের ওপর হামলা ও পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানের নেতৃত্বে একদল লোক এ ঘটনা ঘটায়। এতে পুলিশের পরিদর্শক আহম্মেদ আলীসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন।

গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি মীর মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান রাতে বলেন, সদরে গ্রেপ্তার ৪৮ জনকে শুক্রবার আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

কোটালীপাড়া থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনে এ মামলা করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

কাশিয়ানী থানায় সড়ক অবরোধ করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযোগে সন্ত্রাস দমন আইনের মামলায় ৭০ জনের নাম উল্লেখ করে ২৫০-৩৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। গোপালগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার (মুকসুদপুর সার্কেল) মোহাম্মদ আব্দুল বাছেদ বলেন, সড়কে প্রতিবন্ধকতা তৈরির ঘটনায় বৃহস্পতিবার কাশিয়ানী থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা করা হয়। ওই মামলায় ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ছয়জন শিশু, স্বজনদের উদ্বেগ

১৬ বছরের কিশোর আবীর হোসেন শুভ বৃহস্পতিবার রাতে মায়ের থাইরয়েডের ওষুধ কিনতে বের হয়েছিল। সদরের গেটপাড়া এলাকা থেকে তাকে আটক করে পুলিশ। তার মা আফরোজা আক্তার বর্ণা দাবি করেন, ‘ওর হাতে ওষুধ ছেল। তার পরও ওরে ধরছে। ওর সাথে ফুফাতো ভাই নাফিস হাওলাদার শিপনরেও (১৫) ধরেছে।’

আফরোজা আক্তার জানান, শুভ এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। চার বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়ার পর অসুস্থতার কারণে আর দিতে পারেনি। তার বাবা জাহিদুল ইসলাম মারা গেছেন। আর শিপন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। তার বাবা মানিক হাওলাদার একজন গাড়িচালক।

মায়ের কোলে চড়ে ভাইকে দেখতে থানার সামনে এসেছিল শুভর তিন বছর বয়সী ছোট ভাই আলভী ইসলাম জাইন। সে বারবার বলছিল, ‘মা ভাইয়া আসে না ক্যান?’

জাইনের মতোই মায়ের সঙ্গে বাবার খোঁজে এসেছিল পাঁচ বছরের সামিয়া। সে তার মা স্বপ্না বেগমকে জিজ্ঞেস করছিল, ‘মা আব্বু কনে? কাপড় পরবে না?’ তার হাতে থাকা ব্যাগে ছিল বাবার জন্য আনা কাপড়।

গৃহকর্মী স্বপ্না বেগম জানান, তাঁর স্বামী শামীম শেখ (২২) শহরের বিসিক এলাকার বিস্কুট কারখানার শ্রমিক। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার সময় কাজ শেষে টাকা নিয়ে বের হন তিনিসহ পাঁচ শ্রমিক। কারখানার সামনে থেকে তাদের পাঁচজনকেই আটক করা হয়। বাকি চারজনের নাম তিনি বলতে পারেননি।

সদরের মাস্টারপাড়ায় থাকেন শামীম শেখ। তাঁর মা শুকুরান বেগম দাবি করেন, তাঁর ছেলে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত নয়।

বিসিক এলাকার আরশাদনগর মাদ্রাসা এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দুই শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। তারা এস কে সালেহা কামিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্র হাম্মাদুল ইসলাম রিপন (১৪) ও জেলা প্রশাসন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র কাজী মোকাররম হোসেন (১৩)।

রিপনের বাবা বালা মোল্লা পেশায় ভ্যানচালক। তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যায় ঝালমুড়ি খাওয়ার জন্যি বাসার সামনে যায় রিপন। তহন পুলিশ তারে ধরে নিয়ে গেছে।’ রিপনের মা রেনু বেগম জানান, তাঁর ছেলের পরীক্ষা চলছে। আটক করার কারণে তার পরবর্তী পরীক্ষাগুলো দেওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

মোকাররমের বাবা ব্যবসায়ী কাজী আলম বলেন, ‘কী কারণে তাকে ধরেছে সেটিও জানতে পারিনি। পরে শুনতে পেলাম বুধবারের সংঘর্ষে জড়িতদের ধরতে অভিযানে তাকে আটক করা হয়েছে।’

মোকাররমের প্রতিবেশী বিসিক কর্মকর্তা রফিক আহমেদ বলেন, ‘এইটুকু ছেলেরে ধরে এনেছে। খুবই ভদ্র ছেলে। তাই আমিও থানায় এসেছি। কিন্তু কী হবে বুঝতে পারছি না।’

আরেক কিশোর আকাশ শেখ (১৬) থাকে গোপালগঞ্জের মাঝিগাতির ডালনিয়ায়। তার বাবা জুয়েল শেখ পেশায় রিকশাচালক। মা বিলকিছ বেগম বলেন, ‘মাদ্রাসায় পড়ত আকাশ। মাথায় সমস্যার কারণে পড়া চালিয়ে যেতে পারেনি। বুধবার বিকেলে সদরের কংসুরে মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে তাকে ধরেছে পুলিশ। শুনেছি, তাকে মারধরও করেছে।’ পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার সময় আকাশকে ছবি তুলতে দেখা গেছে। তবে তা মানতে নারাজ বিলকিছ।

দশম শ্রেণি পড়ুয়া দীপু বল্লভ (১৬) লেখাপড়ার পাশাপাশি জারে ভরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের কাজ করে। মা লতিকা বল্লভ জানান, তাঁর স্বামী অসিত বল্লভ অসুস্থ বলে ছেলে কাজ শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে শহরের লঞ্চঘাট এলাকায় পানি সরবরাহের জন্য গেলে তাকে আটক করা হয়।

একই সঙ্গে আটক করা হয় পানি সরবরাহের ব্যবসায় যুক্ত নয়ন দাসকে (২০)। তাঁর মা মিনতি দাস জানান, ডিগ্রিতে (স্নাতক) ভর্তি হয়েছিলেন নয়ন। আর্থিক অনটনের কারণে পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি। পানি পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে উপার্জন করতেন। তাঁর বাবা নেই।

৬০ বছর বয়সী মাছ ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বুধবারের সংঘর্ষের সময় শহরের আদালত এলাকায় ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে বিল কাজলিয়া এলাকার বাসা থেকে তাঁকে আটক করা হয়। তাঁর স্ত্রী নূর নাহার জানান, জমিসংক্রান্ত মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য এসেছিলেন দেলোয়ার। ফেরার পথে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আহত হন। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে তিনি বাসায় ফিরে যান। তিনি কোনো রাজনৈতিক মিছিল-মিটিংয়ে যান না। তবু তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে।

কৃষিকাজের পাশাপাশি মাছ চাষ করেন ৭০ বছর বয়সী মোদক হালদার। পরিবার নিয়ে থাকেন শহরের কুয়োডাঙা এলাকায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি পুলিশলাইন এলাকায় চা খেতে গেলে তাঁকে আটক করে পুলিশ। তাঁর স্ত্রী শিখা হালদার ও পুত্রবধূ রমা বিশ্বাস দাবি করেন, বয়স্ক মানুষটি কারও সাতেপাঁচে নেই। রাজনীতির সঙ্গে কখনোই ছিলেন না।

কয়েকজন যুবককেও ধরে এনেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে ২৩ বছর বয়সী ওসমান গনি ওরফে শুকচান বাগচী (ধর্মান্তরিত) পেশায় অটোরিকশা চালক। তাঁর স্ত্রী স্বপ্না বেগম জানান, পরিবারের সঙ্গে সদরের মানিকদহ আশ্রয়কেন্দ্রে থাকেন গনি। বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে গেটপাড়া এলাকা থেকে বাসায় ফেরার পথে তাঁকে আটক করা হয়।

আরেক রিকশাচালক ইশা খন্দকারকে (২৩) আটক করা হয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে চৌরঙ্গী এলাকা থেকে। তাঁর স্ত্রী সানজিদা বেগম জানান, সদরের বেতগ্রাম এলাকায় থাকেন তারা। পুলিশ থামতে বললে তিনি ভয়ে দৌড় দেন। এরপর তাঁকে ধাওয়া করে ধরে পুলিশ।

ইয়াছিন শেখ বিসিক এলাকার একটি ওয়ার্কশপে মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেন। তাঁর বাবার নাম হাবিল শেখ। তারা থাকেন সদরের গোসাইচর উত্তরপাড়ায়। মা নাজমা বেগম বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে স্থানীয় নদীতে গোসল করতে গিয়েছিলেন ইয়াছিন। সেখান থেকে ভেজা শরীরে তাকে ধরে নেওয়া হয়। সে বুধবারের ঘটনায় জড়িত বলে দাবি করেছে পুলিশ। অথচ সেদিন সে খুলনার তেরখাদার চুনখোলা এলাকায় ওয়ার্কশপে তৈরি জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে গিয়েছিল।’

গোপালগঞ্জ সদরের চরমানিকদহ এলাকার ২৬ বছর বয়সী আরমান হোসেন পেশায় ইজিবাইক চালক। বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে লঞ্চঘাট থেকে তাঁকে আটক করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে ঢিল ছুড়েছিলেন। তবে তাঁর বাবা জুম্মন মোল্লার দাবি, ‘ওই সময় আমার ছেলে নড়াইলের যোগানিয়া বাজার ঘাট এলাকায় ছিল।’

অটোরিকশাচালক অনিক (১৯) পরিবারের সঙ্গে থাকেন সদরের মানিকদি গুচ্ছগ্রাম এলাকায়। তাঁর বাবা এবাদুল মিয়া জানান, অনিক ও তাঁর খালাতো ভাই তরিককে (২২) বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে লঞ্চঘাট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুই তরুণকে নির্দোষ দাবি করেন এবাদুল।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow