‘নুরাল পাগলা’র দরবারে হামলা-সংঘর্ষ, মৃত্যুর গুঞ্জন নিয়ে যা বলছে প্রশাসন

রাজবাড়ী প্রতিনিধি
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে ‘নুরাল পাগলার’ কবর, বাড়ি ও দরবার শরিফে ‘তৌহিদি জনতার’ নামে হামলা-ভাঙচুরের সময় ভক্তদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় মৃত্যুর গুঞ্জন ছড়ালেও প্রশাসন নিশ্চিত করে কিছু বলছে না।
শুক্রবার বিকালে গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জুড়ান মোল্লাপাড়ায় এলাকায় এ ঘটনায় নুরুল হকের লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এর আগে সংঘর্ষের মধ্যে আহত হয়ে হাসপাতালে গেছেন অন্তত ২২ জন। সেখানে দুইজনের মৃত্যুর খবর ‘শোনার’ কথা বলেছে পুলিশ, প্রশাসন ও সিভিল সার্জনের কার্যালয়, তবে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না।
জেলার পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরাও আপনাদের মত শুনছি যে, এক-দুজন মারা গেছেন। কিন্তু অফিশিয়ালি আমাদের কাছে এখনও এমন কোনো তথ্য নেই।”
তিনি বলেন, “যে সময় ঘটনা ঘটে, তখন আমরা ঘটনাস্থলে ছিলাম। যারা আহত হয়েছেন তাদের আমরা উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছি। আমরা এখনও ঘটনাস্থলে আছি। তবে এর মধ্যে কেউ মারা গেছেন কি-না আমরা এখনও রিপোর্ট পাইনি।”
জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তারের কাছে জানতে চাইলে তিনিও বলেন, “আপনার মত অনেকেই আমার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন। কিন্তু রাজবাড়ী বা গোয়ালন্দে মারা যাওয়ার কোনো খবর নেই।
তিনি বলেন, “আহত অবস্থায় ২২ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। তাদের মধ্যে তিনজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। বাকিদের ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেটা সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে আমরা জানি।
“এরপর কেউ মারা গেছেন কি-না সেটা আমরা এখনও জানি না। হয়ত ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগাযোগ করলে আপনার সেটা জানতে পারেন।”
জেলা সিভিল সার্জন এস এম মাসুদ বলেন, “আহতদের মধ্যে ২২ জনকে আমরা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছি। তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল।
“আমিও শুনেছি দুজন মারা গেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে এখনও কোনো পুলিশ রিপোর্ট পাইনি। রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না।”
মৃত্যুর খবর পেলেও নিশ্চিত হতে না পারার কথা জানিয়েছেন গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদুর রহমান।
নিজেকে ইমাম মাহাদি দাবি করা নুরুল হক সম্প্রতি মারা যাওয়ার পর মাটি থেকে কিছুটা উপরে কবর তৈরি করে তাকে দাফন করা হয়। কবরটির কাবা শরিফের আদল দেওয়া হয়। এ নিয়ে তৌহিদি জনতার মধ্যে গত কয়েকদিন ধরেই উত্তেজনা চলছিল। স্থানীয় প্রশাসন দুপক্ষকে সঙ্গে নিয়ে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছিলেন।
তার মধ্যেই জুমার নামাজের পর পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, বিভিন্ন স্থান থেকে তৌহিদি জনতা এসে শহীদ মহিউদ্দিন আনসার ক্লাবে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন। তারা নুরুল হকের বাড়ি ও দরবারের ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। পরে তারা দরবার শরিফ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
পুলিশ আগে থেকেই সেখানে থাকলেও বিপুল মানুষের কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তারা সক্ষম হয়নি। পরে সেনাবাহিনী ও র্যাব এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
তখন ‘তৌহিদি জনতা’ নামধারীরা পিছু হটে নুরুল হকের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বিক্ষোভ করে। এ সময় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্যরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়।
তখন আহতদের উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে পাঠায়।
এর কিছু পরে বাড়িতে গিয়ে দ্বিতীয় দফায় হামলা চালায় হামলাকারীরা। তখন তারা বাড়ির সামনে থাকা নুরুল হকের কবর থেকে মরদেহ তুলে নিয়ে চলে যায়। পরে তারা মরদেহটি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পদ্মার মোড়ে নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
এ সময় হামলাকারীদের একজন মো. আল আমিন বলেন, “নুরাল পাগল একটা সময় নিজেকে ইমাম মাহাদি দাবি করেছেন। পাশাপাশি তিনি খোদাও দাবি করেছেন। তার কর্মকাণ্ড ছিলে শরিয়তবিরোধী। এসব ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মেনে নিতে পরে নাই। যে কারণে জনতা আজ নুরাল পাগলের দরবার ভেঙে দিয়েছে। বাড়িঘর ভাঙচুর করে আগুন দিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে তার লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলেছে।”
রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম বলেন, “জুমার নামাজের পর তৌহিদি জনতা জড়ো হন। তাদের একটা অংশ দেশীয় অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। সে সময় পুলিশের গাড়ি ও ইউএনওর গাড়ি ভাঙ্চুর করে। পরে নুরুল হকের বাড়িতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে।”
বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানান পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম।
স্থানীয়রা জানান, নুরুল হক আশির দশকের মাঝামাঝি নিজেকে ‘ইমাম মাহাদি’ বলে দাবি করেছিলেন। তখন চাপের মুখে তিনি এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন। পরে আবার তিনি এলাকায় ফিরে আসেন। তার বেশ কিছু ভক্ত-অনুসারীও রয়েছে।
২৩ অগাস্ট ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। পরে তার প্রতিষ্ঠিত গোয়ালন্দ দরবার শরীফের ভেতরে কাবা শরিফের আদলে রং করা মাটি থেকে প্রায় ১২ ফুট উঁচু বেদিতে দাফন করা হয়।
এরপর থেকে কবর নিচু, রঙ পরিবর্তন ও ইমাম মাহাদির দরবার শরিফ লেখা সাইনবোর্ড অপসারণের দাবি তোলেন তৌহিদি জনতা বিক্ষোভ করে আসছিলেন।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে উভয় পক্ষকে নিয়ে একটি সভাও হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলা প্রশাসন বিষয়টি সমাধানে একটি কমিটিও গঠন করে।
কবরের ব্যাপারে প্রশাসন নুরুল হকের পরিবারের সঙ্গে কথাও বলে। পরিবার বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় নিয়েছিল। শুক্রবার সেখানে হামলার ঘটনা ঘটল।
থমথমে পরিস্থিতির কারণে নুরুল হকের পরিবার বা তার ভক্তদের সঙ্গে কথা বলা যায়নি। তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে।
What's Your Reaction?






