এস আলম ও সিকদার পরিবারসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করবে দুদক

জালিয়াতির মাধ্যমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) ও সিকদার পরিবারের সদস্যসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) বিকেলে মামলা অনুমোদনের তথ্য জানান দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন।
তিনি বলেন, মামলার আসামির তালিকায় এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলমের স্ত্রী, ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ফারজানা পারভীনের নামও রয়েছে।
মো. আক্তার হোসেন বলেন, ঋণ গ্রহণের ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও শর্তভঙ্গের মাধ্যমে গ্রাহক প্রতিষ্ঠান এসকিউ ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের মতো নবীন গ্রাহকের কোনো বাস্তবসম্মত ঋণপ্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও, প্রকল্প পরিদর্শন প্রতিবেদন ছাড়াই ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।
দুদক মহাপরিচালক বলেন, ঋণগ্রহীতার সক্ষমতা যাচাই না করে এবং প্রয়োজনীয় রেকর্ড পরীক্ষা না করেই ওয়ার্ক অর্ডারের বিপরীতে ব্যাংক ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করেছে। তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, এ অর্থ উত্তোলন, স্থানান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
এ কারণে সিকদার পরিবারের সদস্য রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার, ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. সাইফুল আলমসহ মোট ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বলে জানান দুদকের মহাপরিচালক।
দুদক সূত্রে জানা যায়, মামলায় আসামির সংখ্যা ২৬ জন এবং আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ মূলধন ১১০ কোটি টাকা; সুদসহ মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০৭ কোটি ৪২ লাখ টাকারও বেশি।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিকদার গ্রুপের কর্মচারী সৈয়দ কামরুল ইসলাম ‘এস. কিউ. ট্রেডিং অ্যান্ড ডেভেলপার’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান খুলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করেন। ওই ট্রেড লাইসেন্স নেওয়ার মাত্র ১৫ দিন পর, ২০১৯ সালের ৬ জানুয়ারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় ওই প্রতিষ্ঠানের নামে একটি আল-ওয়াদিয়াহ চলতি হিসাব খোলা হয়। হিসাব খোলার ক্ষেত্রে পরিচয়দানকারী ছিলেন সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের নাতি এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক পরিচালক রন হক সিকদারের ছেলে জন হক সিকদার। হিসাব খোলার পরদিনই, অর্থাৎ ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি সিকদার পরিবারের পাওয়ার প্যাক হোল্ডিংস লিমিটেড-এর একটি ওয়ার্ক অর্ডারের বিপরীতে এস. কিউ. ট্রেডিং অ্যান্ড ডেভেলপারের অনুকূলে বাই-মুরাবাহা (জেনারেল) বিনিয়োগ সীমা ১১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদনের আবেদন করা হয়।
এতে আরও বলা হয়, একজন নবীন গ্রাহক হওয়া সত্ত্বেও এ আবেদনটি বিবেচনায় নিয়ে তড়িঘড়ি করে ঋণ প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হয়। গ্রাহকের আবেদন পাওয়ার পর ‘প্রস্তাবটি ব্যাংকের প্রচলিত বিনিয়োগ নীতিমালার আওতাভুক্ত’ মর্মে সুপারিশসহ অফিস নোট প্রস্তুত করা হয় এবং কোনোরূপ জামানত ছাড়াই, প্রকল্প পরিদর্শন প্রতিবেদন ছাড়া, আইনজীবী ও অডিটরের মতামত ব্যতীত এবং জামানতের প্রকৃত মূল্য যাচাই না করেই ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ব্যাংকের ২০৫তম পরিচালনা পর্ষদ সভায় ঋণ অনুমোদন করা হয়।
পরবর্তীতে, ২০১৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাই-মুরাবাহার অনুকূলে ১১টি ইন্সট্রুমেন্টের মাধ্যমে মোট ১১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা জমা করা হয়। একই দিনে ওই অর্থ থেকে এম. এস. কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপারসের অনুকূলে ৪৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা, মাহবুব এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে ৩১ কোটি টাকা এবং ম্যাম ইমপেক্সের অনুকূলে ৩২ কোটি টাকা তিনটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ন্যাশনাল ব্যাংকের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে এই অর্থ চেকের মাধ্যমে উত্তোলন দেখিয়ে পুনরায় সিকদার পরিবার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এভাবে পরস্পর যোগসাজশে নিজেদের লাভবান করার উদ্দেশ্যে প্রতারণা, জালজালিয়াতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে নবীন গ্রাহক এস. কিউ. ট্রেডিং অ্যান্ড ডেভেলপার-এর নামে ঋণ গ্রহণ করা হয়। বাস্তবসম্মত প্রয়োজনীয়তা ব্যতীত, সহযোগী জামানত প্রদান না করেই, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই না করে এবং রেকর্ডপত্র যাচাই-বাছাই না করেই অনুমোদিত এই ঋণ সম্পূর্ণ অর্থ একদিনেই উত্তোলন করা হয়। ফলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’র আসল ১১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা সুদসহ ৩০ জুন ২০২৫ তারিখ পর্যন্ত বকেয়া দাঁড়ায় মোট ২০৭ কোটি ৪২ লাখ ২২ হাজার ৭৬৯ টাকা।
এই অর্থ জ্ঞাতসারে স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে, এর অবস্থান, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন ও ছদ্মাবৃত্ত করা হয় বলে দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
মামলার আসামিরা হলেন- জয়নুল হকের তিন ছেলে রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার ও মমতাজুল হক সিকদার এবং দুই মেয়ে লিসা ফাতেমা হক সিকদার ও পারভীন হক সিকদার।
এছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম এবং তার স্ত্রী, ব্যাংকটির সাবেক পরিচালক ফারজানা পারভীনও এ মামলার আসামি।
তালিকায় রয়েছেন এস. কিউ. ট্রেডিং অ্যান্ড ডেভেলপারের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ কামরুল ইসলাম, এম. এস. কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপারস ও ম্যাম ইমপেক্সের স্বত্বাধিকারী মো. সালাউদ্দিন এবং মাহবুব এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মাহবুব-ই-করিম।
এছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি-র কারওয়ান বাজার শাখার সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপক এম. এম. মোস্তাফিজুর রহমান, ব্যাংকের সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অব.) মো. জহুরুল হক, সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অব.) আব্দুল আজিজ, তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মালেক, সাবেক পরিচালক আতিকুর নেছা, সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক মোহাম্মদ ইসহাক, সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক আহমদ মুক্তাদির আরিফ, সাবেক মনোনীত পরিচালক খন্দকার ইফতেখার আহমদ, সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক মনোনীত পরিচালক বদরুন নেছা, সাবেক পরিচালক মো. ওয়াহিদুল আলম শেঠ, সাবেক মনোনীত পরিচালক জামাল মোস্তফা চৌধুরী এবং সাবেক মনোনীত পরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবর, এনডিসি, পিএসসি-তাদের বিরুদ্ধেও মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
মামলার তালিকায় আরও রয়েছেন মো. শেখ আলম এবং মনীশঙ্কর বিশ্বাস।
What's Your Reaction?






