পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.)-এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য : ড. মুহাম্মদ নাছিরউদ্দীন সোহেল

মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধু রাহমাতুল্লিল আলামিন হজরত মোহাম্মদ (সা.)-কে হিজরি পূর্ব ৫৩ সালের ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের সময় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রেরণ করেন। ১২ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি হযরত রাসুল (সা.)-এর ১৫০০তম শুভ জন্মদিন (হিজরি সাল অনুযায়ী)। জগতের বুকে আল্লাহর প্রিয় হাবিবের আগমনের দিনটিকে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি (সা.) বলা হয়।
মিলাদ আরবি শব্দ, এর বাংলা অর্থ জন্ম, জন্মকাল, জন্মদিন। মিলাদুন্নবি (সা.) বলতে বুঝায় মহানবি (সা.)-এর জন্মদিন।
‘আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ কিতাবে বর্ণিত’- হযরত আমিনা (আ.) বলেন, “প্রশংসিত সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় আমি তাঁকে সেজদারত অবস্থায় দেখেছিলাম। উভয় হাতের তর্জনী অঙ্গুলি দোয়া ক্রন্দনকারীর ন্যায় আকাশের দিকে প্রসারিত ছিল।”
তিনি আরো বলেন, “সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর কারা যেন তাঁর সন্তানটিকে নিয়ে গিয়ে সমস্ত সৃষ্টিজগত পরিভ্রমণ করান। তিনি তাঁদের কথাবার্তা শুনেছিলেন। তিনি ঊর্ধ্বলোকের সম্মানিত ব্যক্তিগণের কথাবার্তার এক অংশে শুনেছিলেন যে, মোহাম্মদকে সকল নবির গুণাবলিতে বিভূষিত করো এবং সকল আম্বিায়ায়ে কেরামের চরিত্র সাগরে ডুবিয়ে দাও।”
হযরত রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরাম তাঁদের বাড়িতে ধুমধামের সাথে শুভ জন্মদিনের আয়োজন করতেন। তাফসীরে জালালাইনের অন্যতম লেখক হযরত আল্লামা ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি (রহ.) প্রণীত ‘সাবিলুল হুদা ফি মাওলিদিল মুস্তফা’ কিতাবে হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে, “বিখ্যাত সাহাবি হযরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে।
তিনি বলেন- একদা আমি হযরত রাসুল (সা.)-এর সাথে আবু আমের আনসারি (রা.)-এর বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেলাম, হযরত আমের (রা.) তাঁর ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়স্বজনকে একত্রিত করে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মদিনের বিবরণ শোনাচ্ছেন। অতঃপর তিনি বলছিলেন- আজ সেই পবিত্র জন্মদিন। তাঁর এই কাজ দেখে হযরত রাসুল (সা.) বললেন- হে আমের! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তায়ালা তোমার জন্য তাঁর রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন এবং ফেরেশতারা তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন।”
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, “একদা তিনি তাঁর ঘরে লোকদেরকে একত্রিত করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিনের বর্ণনা করছিলেন, যা শুনে উপস্থিত সবাই আনন্দে আত্মাহারা হয়ে হযরত রাসুল (সা.)-এর প্রশংসা করছিলেন (দরুদ ও সালাম পেশ করছিলেন)। এমন সময় হযরত রাসুল (সা.) সেখানে উপস্থিত হলেন এবং তাদের উদ্দেশে বললেন- ‘তোমাদেরকে শাফায়াত করা আমার জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে’।”
(দুররুল মুনাজ্জাম) হজরত আবু কাতাদা আনসারী (রা.)- থেকে বর্ণিত হয়েছে, “হজরত রাসুল (সা.)-কে সোমবার রোজা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন- এই দিনে আমি জন্ম নিয়েছি, আর এই দিনে আমার ওপর কোরআন নাজিল হয়েছে।”
ইমাম বোখারি (রহ.) বর্ণনা করেন, “হযরত উরওয়া (রা.) বলেন-সুওয়াইবা ছিল আবু লাহাবের দাসী এবং আবু লাহাব তাকে (মোহাম্মদ (সা.)-এর শুভ জন্মের সংবাদ দেওয়ার কারণে খুশি হয়ে) আজাদ করে দিয়েছিল। এরপর সুওয়াইবা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দুধ পান করায়। অতঃপর আবু লাহাব যখন মারা গেলো, তার একজন আত্মীয় তাকে স্বপ্ন দেখল যে, সে ভীষণ কষ্টের মধ্যে রয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করল- তোমার সাথে কীরূপ ব্যবহার করা হয়েছে? আবু লাহাব বলল- যখন তোমাদের থেকে দূরে রয়েছি, তখন থেকেই ভীষণ কষ্টে আছি। তবে দাসী সুওয়াইবাকে এই আঙুলের ইশারায় (শাহাদত অঙ্গুলি) আজাদ করার কারণে আমাকে পানীয় পান করানো হয়।”
(বোখারি শরীফ ২য় খণ্ড, ‘কিতাবুন নিকাহ’ অধ্যায়, পৃষ্ঠা ৭৬৪) সুতরাং হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের সংবাদে খুশি হওয়ায় একজন কাফের হয়েও যদি আবু লাহাবের আজাব লাঘব হতে পারে, তাহলে সেই রাসুল (সা.)-এর উম্মত হয়ে আমরা যদি তাঁর শুভ জন্মদিন মহাধুমধাম ও আনন্দের সাথে মিলাদ পাঠের মাধ্যমে উদ্যাপন করি, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরাও সৌভাগ্য লাভ করে উপকৃত হতে পারবো। হজরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মের সময় বহু অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়। যেমন- (১) নওশেরাওয়া বাদশাহর সিংহাসন নড়ে ওঠে; (২) মাওয়া দরিয়া শুকিয়ে যাওয়া; (৩) সাম হওয়া হ্রদ পানিতে ভরে যাওয়া; (৪) পারস্যের অগ্নিকুন্ড হঠাৎ নিভে যাওয়া; (৫) ক্বাবা ঘরের ‘হুবুল’ নামক বৃহৎ মূর্তিটির উপুর হয়ে পড়ে যাওয়া ইত্যাদি। মহান আল্লাহ আমাদেরকে হজরত রাসুল (সা.)-এর শুভ জন্মদিন যথাযথ মর্যাদায় উদ্যাপন করার তৌফিক এনায়েত করুন। আমিন।
লেখক, গবেষক, কদর রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন্স; সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, পিইউবি
What's Your Reaction?






