রাষ্ট্রীয় শোক উপেক্ষা করে রাজধানীতে উচ্ছৃঙ্খল থার্টিফার্স্ট নাইট

Dec 31, 2025 - 19:17
 0  2
রাষ্ট্রীয় শোক উপেক্ষা করে রাজধানীতে উচ্ছৃঙ্খল থার্টিফার্স্ট নাইট
ছবি : সংগৃহীত

রাষ্ট্রীয় শোক আর আইনি নিষেধাজ্ঞার আবহে রাজধানীর রাত হওয়ার কথা ছিল সংযত, নীরব ও শোকাবহ। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। শোক ও আইন—দুটোকেই উপেক্ষা করে থার্টিফার্স্ট নাইটে রাজধানী ঢাকার আকাশ ভরে ওঠে আতশবাজির আলোয়, বাতাস ভারী হয় পটকার বিকট শব্দে, আর অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে গান-বাজনা ও উচ্ছৃঙ্খল উল্লাস। তরুণ যুবকদের গাড়ি ও মোটরসাইকেল নিয়ে দল বেঁধে বিভিন্ন এলাকায় হর্ন বাজাতে বাজাতে ঘুরতে দেখা গেছে। নতুন বছরকে বরণ করার নামে রাজধানীর বিস্তীর্ণ অংশে রাতভর চলেছে আইন অমান্য, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও দায়িত্বহীন উদযাপন।

খ্রিষ্টীয় নতুন বছর উপলক্ষে সরকার আগেই আতশবাজি ও পটকা ফোটানো নিষিদ্ধ করেছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাষ্ট্রীয় শোক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালনের ঘোষণা দেয় সরকার। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) মহানগর এলাকায় সব ধরনের আতশবাজি, পটকা, ফানুস ও গ্যাস বেলুন ওড়ানো নিষিদ্ধ করে। একই সঙ্গে উন্মুক্ত স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ডিজে পার্টি, র‍্যালি ও শোভাযাত্রা আয়োজনেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। উচ্চ শব্দে গাড়ির হর্ন বাজানো কিংবা জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে এমন কর্মকাণ্ড থেকেও বিরত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

ডিএমপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, শোক পালনকালীন সময়ে নগরবাসীর সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তবে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতায় দেখা গেছে, সেই সহযোগিতার প্রতিফলন রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় ছিল না বললেই চলে। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই শোকের আবহ মিলিয়ে যায় আতশবাজির শব্দে, আর নিষেধাজ্ঞা হারিয়ে যায় উচ্ছৃঙ্খল উদযাপনের ভিড়ে।

বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যার পর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, চকবাজার, বংশাল, কোতোয়ালি, ওয়ারী, সূত্রাপুর ও গেন্ডারিয়ায় ব্যাপক আতশবাজি ও পটকা ফোটানো হয়েছে। পুরান ঢাকার এসব এলাকায় বাসাবাড়ির ছাদে ছাদে আয়োজন করা হয় গান-বাজনা, আলোকসজ্জা ও বারবিকিউ পার্টির। হিন্দি ও পশ্চিমা গানের তালে তরুণ-তরুণীদের নাচ-গানে মেতে উঠতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও প্রকাশ্যেই মাদক সেবনের অভিযোগও ওঠে।

রাত সাড়ে ১১টার পর থেকে আতশবাজি ফোটানোর মাত্রা আরও বেড়ে যায়। রাত বারোটা এক মিনিট থেকে পুরো ঢাকার আনাচে-কানাচে ফানুস, পটকা ও আকাশরঙা আতশবাজি ফোটাতে দেখা যায়।

এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন মদের বার ঘুরে দেখা যায়, বিকাল পাঁচটার পর থেকে খাওয়া ও পার্সেল দেওয়া বন্ধ থাকলেও বারগুলোর বাইরে উঠতি বয়সী যুবক-কিশোরদের ভিড় জমে। হাতিরঝিল এলাকায় কয়েকটি চেকপোস্ট থাকলেও কিছু মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার নিয়ে তরুণদের থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন করতে দেখা গেছে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। একদিকে ডিএমপির নিষেধাজ্ঞা, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় শোক—সবকিছুর পরও পুরান ঢাকার চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানকার একটি অংশ ঐতিহ্যের কথা বলে সব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন করে।

গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা আব্দুল কাদের বলেন, শোকের সময়েও এমন উদযাপন তার কাছে অমানবিক মনে হয়েছে। তিনি বলেন, শিশুরা আতশবাজির শব্দে ভয়ে ঘুম থেকে উঠে যাচ্ছে। বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষদের কষ্ট কেউ দেখছে না। সূত্রাপুর ও ওয়ারীর বাসিন্দারাও একই অভিযোগ করেন। তাদের মতে, পুলিশ উপস্থিত থাকলেও অধিকাংশ এলাকায় নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে দৃঢ়তা দেখা যায়নি।

শাঁখারীবাজার, চকবাজার ও লালবাগের সংকীর্ণ গলিতে পটকা ফোটানোয় আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। স্থানীয়দের মতে, আগুন লাগার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করা হয়েছে। কোথাও কোথাও মোটরসাইকেল নিয়ে দলবেঁধে হর্ন বাজিয়ে চক্কর দিতে দেখা গেছে তরুণদের। স্থানীয়দের ভাষায়, উৎসবের নামে এমন আচরণ শুধু আইন ভাঙাই নয়, জননিরাপত্তার জন্যও হুমকি।

তবে একাধিক তরুণের বক্তব্য ছিল ভিন্ন। পুরান ঢাকার কয়েকজন যুবক বলেন, বছরে একটা দিন আমাদের সময়। এটা উদযাপন না করলে খারাপ লাগে। বন্ধুরা জোর করায় সবাই মিলে বের হয়েছি।

হাজারীবাগ, আজিমপুর ও নিউমার্কেট এলাকাতেও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একই দৃশ্য দেখা যায়। ভবনের ছাদে আলোকসজ্জা ও ব্যাপক আতশবাজি ফোটানো হয়।

ধানমন্ডি, সায়েন্স ল্যাব ও জিগাতলাতেও নিষেধাজ্ঞা অমান্যের দৃশ্য চোখে পড়ে। সায়েন্স ল্যাবের পপুলার হাসপাতালের আশপাশ থেকেও আতশবাজি ফোটাতে দেখা যায়। জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে ব্যাপক পটকা ও আতশবাজির শব্দ শোনা যায়। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কসহ আশপাশের এলাকায় মানুষ রাস্তায় নেমে নতুন বছর উদযাপন করে। অনেক প্রাইভেটকারে উচ্চ শব্দে গান বাজিয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়।

মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, মানিকনগর এলাকাতেও সন্ধ্যার পর থেকেই আতশবাজি ও পটকার শব্দ শোনা যায়। মানিকনগরের গৃহবধূ নাজমুল আক্তার নিশা বলেন, এত বড় শোক ও আইনি নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ছাদে ছাদে আতশবাজি ফোটানোয় শিশু ও বয়স্করা ঘুমাতে পারেনি। অনেকেই অসুস্থ।

তবে ব্যতিক্রম ছিল শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। সেখানে রাত ৯টা থেকে পুলিশ ও ভিক্টোরিয়া টিমের কড়া নজরদারি ছিল। আইডি কার্ড ছাড়া কাউকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ধানমন্ডির কিছু গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ তল্লাশিও দেখা গেছে। এসব এলাকায় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়নি, যা দেখিয়েছে—চাইলেই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা সম্ভব।

রাষ্ট্রীয় শোক ও আইনি নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও রাজধানীর বড় একটি অংশে থার্টিফার্স্ট নাইট পরিণত হয় উচ্ছৃঙ্খলতা ও আইন অমান্যের রাতে। সরেজমিন চিত্র ও স্থানীয়দের বক্তব্য স্পষ্টভাবে বলছে, নির্দেশনা জারি হলেও তার বাস্তব প্রয়োগে বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে। শোকের সময়ে এমন দায়িত্বহীন উদযাপন শুধু আইন ভাঙার ঘটনা নয়; এটি সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব ও প্রশাসনিক দুর্বলতারও নগ্ন প্রতিচ্ছবি।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow