জমিতে পানি শূন্যতায় হুমকিতে মুন্সিগঞ্জে আলু চাষ, বিপাকে চাষিরা

আলুর আবাদি জমিতে পানি শূন্যতায় এবার নানা সমস্যায় জর্জরিত মুন্সিগঞ্জের প্রান্তিক আলু চাষিরা। অন্যদিকে চলতি মৌসুমে বৃষ্টি না থাকায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, কৃষি জমির আশেপাশের খাল বিল প্রভাবশালী মহল ভরাট করে রাখায় অধিকাংশ এলাকায় ব্যাহত হচ্ছে জমিতে সেচ কার্যক্রম। এতে ফলন কম হওয়ার পাশাপাশি এবার লোকসানের শঙ্কায় রয়েছেন আলু চাষিরা। একই সঙ্গে কৃষি জমি শুকিয়ে ফাটল দেখা দেয়ায় এবার বড় দুশ্চিন্তার ভাজ পড়েছে কৃষকের কপালে।
সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, আলুর রাজধানী খ্যাত মুন্সিগঞ্জের বিস্তীর্ণ জমিতে এখন শুধুই সবুজের সমাহ। আলুর চারা গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত চাষিরা তবে চলতি মৌসুমে কৃষি জমিতে পানি শূন্যতায় দেখা দিয়েছে ফাটল। এতে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে না আলুর চারা গাছ। ফলে চলতি মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত ফলন প্রাপ্তি নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন চাষিরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে কৃষকের এমন কর্মযজ্ঞ। আগাছা পরিষ্কার থেকে শুরু করে সেচ, সার, কীটনাশক প্রয়োগে চলে দিনভর ব্যস্ততা। ফলে আলু আবাদের মৌসুমে মুন্সিগঞ্জের দিগন্ত জুড়ে ফসলি মাঠ ভরে উঠে আলু গাছের সবুজ পাতায়। তবে চলতি মৌসুমের শুরুতেই এবার আলু আবাদে পড়তে হয়েছিল অসময়ের বৃষ্টির বিপত্তিতে। এতে নষ্ট হয় জেলার প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে রোপনকৃত আলু বীজ। ফলে এসব জমিতেই আবাদ করতে হয় দুই দফা অন্যদিকে অধিকাংশ জমিতে এবছর আবাদ হয়েছে বিলম্বে। এমন পরিস্থিতিতে আশানুরুপ ফলন নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিনকাটছে কৃষকদের পাশাপাশি ফলন ভালো না হলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণেও দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
সরজমিনে আরও দেখা গেছে, আলুক্ষেতগুলোতে কোথাও ইঞ্জিন চালিত মেশিনের মাধ্যমে পানি ছিটিয়ে দেয়া হচ্ছে আবার কোথাও জমিতে থাকা আগাছা পরিষ্কার ও কিটনাশক ছিটিয়ে রোগের হাত থেকে গাছ রক্ষায় কাজ করছে কৃষক-শ্রমিকেরা।
বিশেষ করে সদর উপজেলার চরাঞ্চলের চরকেওয়ার, বাংলাবাজার, মোল্লাকান্দি, শিলই ও আধারা, মহাকালি, বজ্রযোগিনী, রামপাল ইউনিয়ন এবং টংগিবাড়ী উপজেলার আলদি, ধামারণ, কাঠাদিয়া, শিমুলিয়া, যশলং, ধীপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম এবং সিরাজদিখান, লৌহজং, গজারিয়া ও শ্রীনগর উপজেলা জুড়েও কৃষকের ব্যস্ততার দৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে। তাদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে বিভিন্ন জেলার পুরুষ-নারী শ্রমিক ও কৃষকের পরিবারের সদস্যরাও।
একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবছর সারের দাম ও শ্রমিক খরচ বেশি। বৃষ্টির আগে দেশি ৫০ কেজি আলুর বীজ ছিল ৩ হাজার ৪০০ টাকা । বৃষ্টির পরে সেই বীজ ৬ হাজার টাকা থেকে ৭ হাজার ৫০০ টাকা বিক্রি হয়েছে। জমির ভাড়া খরচও অনেক বেশি।
সদর চরাঞ্চলের হোগলাকান্দি এলাকার শামসুদ্দিন মেম্বার জানান, এবার আমি ৫১০ শতাংশ জমিতে আলু রোপণ করেছি। খরচ হয়েছে ১১ লাখ টাকা। যেটা গতবারের চেয়ে দ্বিগুণ। এবার অসময়ের কয়েক দফা বৃষ্টির প্রভাবে তিন ভাগের দুই ভাগ আলুক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে।
তারপরেও যদি বর্তমান বাজারে যে দাম রয়েছে ওই দাম ঠিক থাকে তাহলে মোটামুটি লোকসান পুষিয়ে নেয়া যাবে। তিনি জানান, বাজারে সকল কিছুর দাম বেশি। সারের দাম গত বছরের চেয়ে দিগুণ। আমি আশা করছি, আমার পুরো জমিতে ২ হাজার মণ আলু উৎপাদিত হবে। তিনি আরও জানান, এখনো কোন প্রকার পোকামাকর বা রোগ বালাই আসেনি। তবে আরও কিছুদিন যত্ন নিতে হবে।
একই এলাকার রমজান আলী মাতবর জানান, গত বছর আলু জমি থেকে বিক্রি করে ভুল হয়েছে। আমার আলু অন্য মানুষ বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা লাভ করেছে। জমিতে আলু বিক্রি করেছি ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা বস্তা (৫০ কেজি)। তিনি বলেন, গেলো বছরের শেষের দিকে বস্তা বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩হাজার টাকা। তবে এবার জমিতে আলু বিক্রি নাও করতে পারি। কিছুদিন আলু বাড়িতে সংরক্ষণ করবো। সরকার যাতে কৃষকের প্রতি নজর দেয়।
সদর উপজেলার মাকহাটি গ্রামের কাঞ্চন বেপারী জানান, আলুর ফলন ভাল পেতে হলে রোপণের পর শ্রম দিতে হয়। এবার বৃষ্টিতে কিছুটা লোকসান হয়েছে। আবার এখন কিছু রোগের ধরণ দেখা দিয়েছে। কৃষি অফিসের লোকজন নিয়মিত যোগাযোগ করছে। তিনি জানান, গত দুই সপ্তাহ ধরে ভাড়া করা মেশিন দিয়ে পানি ছিটিয়ে আলু গাছের পরিচর্যা করছি একটু ভালো ফলনের আশায়। তবে অধিকাংশ জমিতে পানি শূন্যতার কারণে দেখা দিয়েছে ফাটল।
জানা গেছে, এদের মতো জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখন কৃষকরা আলু জমি পরিচর্যা করতে পানি ছিটানো ছাড়াও আগাছা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত।
একই গ্রামের শ্রমিক বাবুল পাল ও রাজু শিকদার জানায়, ভালো ফলনের আশায় কৃষক নান্নু বেপারী গাছ পরিচর্যার জন্য পানি ছিটিয়ে দিতে ৬০০ টাকা মজুরিতে তাদের নিয়োগ করেছেন। তাই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রোপণ করা ১৬ গন্ডা জমিতে পানি ছিটাচ্ছেন তিনি। জমির পাশের খাল বিল ভরাট করে রাখায়, পানি শূন্যতায় বিপাকে পড়েছেন আলু চাষিরা।
অন্যদিকে মাকহাটি গ্রামের কৃষক মইনুদ্দিন সুমন মোল্লা জানান, তিনি ৪৬৬ শতাংশ জমিতে আলু রোপণ করেছেন। আলুর ফলন ভালো হবে এমন আশায় এখন প্রতিদিনই তিনি শ্রমিকদের নিয়ে ইঞ্জিনচালিত মেশিন দিয়ে জমিতে পানি ছিটানোর কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
এমন পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত জমি পরিদর্শন করে কৃষকের লোকসান এড়াতে এবার সরকারিভাবে আলু ক্রয় করে মজুত রাখার প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন মুন্সিগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত। তিনি জানান, জেলার কিছু কিছু জমি থেকে আগাম আলু উত্তোলন শুরু হয়েছে। বাজারে ভালো দামও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্ত বর্তমানে যে আলু জমিতে রয়েছে সেগুলো উত্তোলন শুরু হবে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে।
তিনি আরও জানান, আবহাওয়া ধারাবাহিকভাবে বেশি কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। আমরা এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি যাতে ছত্রাকনাশক ওষুধ দেওয়া হয়। যদি পরিস্থিতি অতিরিক্ত খারাপ হয়ে পরে তাহলে কৃষকরা যাতে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নেয়।
জেলায় নভেম্বরের শুরুতেই সদর, সিরাজদিখান, লৌহজং, টংগিবাড়ী, গজারিয়া ও শ্রীনগর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আলু আবাদ করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলু আবাদ হয়েছে জেলা সদরে। গেল দুই বছর আলুর বাজার মূল্য ভালো থাকায় চলতি মৌসুমে আলু আবাদে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকের। এবার জেলায় ৩৪ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ করা হয়েছে এতে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিধার্রণ করা হয়েছে প্রায় ১০ লাখ ৪৫ হাজার ১৯৫ মেট্রিক টন।
What's Your Reaction?






