সাদুল্লাপুরে ক্যাসিনো ডিলার ও ডিবির ভুয়া সোর্স আটক, মধ্যরাতে থানা থেকে মুক্তি

গাইবান্ধা প্রতিনিধি
গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে অনলাইন জুয়া ক্যাসিনো ডিলার হিসেবে পরিচিত মহন্ত চন্দ্র (২৫) ও ডিবি পুলিশের ভুয়া সোর্স পরিচয় দেওয়া লেবু মিয়া (২৫) নামে দুই যুবককে আটক করে থানায় নেওয়ার পর মধ্যরাতে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
এছাড়াও অপর একটি অভিযানে পুলিশ ফিরোজ মিয়া (৩৫) নামে আরও এক ক্যাসিনো চক্রের সদস্যকে হাতেনাতে ধরেও তাকে আটক না করে শুধু মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। পরে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সেই মোবাইল ফেরত দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
গত শুক্রবার (১১ অক্টোবর) মধ্যরাতে সাদুল্লাপুর থানা থেকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ ফিরোজের জব্দ মোবাইলটি তার মধ্যস্থকারীকে ফেরত দেয়। ঘটনাগুলো গোপন থাকলেও স্থানীয়ভাবে জানাজানি হয় এবং কয়েকজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করলে তা ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে দুই দিন ধরে উপজেলা জুড়ে সমালোচনা সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নলডাঙ্গা ইউনিয়নের প্রতাপ গ্রামের বিলাশ চন্দ্র শীলের ছেলে মহন্ত চন্দ্র ও একই গ্রামের মৃত্যু বাচ্চা মিয়ার ছেলে লেবু মিয়া দীর্ঘদিন ধরে অনলাইন ক্যাসিনো জুয়ার সঙ্গে জড়িত। মহন্ত স্থানীয়ভাবে ‘ডিলার’ হিসেবেও পরিচিত, আর লেবু তার কাছে একাউন্ট খুলে নিয়ে জুয়ায় জড়ায়। এরমধ্যে টাকা লেনদেন নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ডিলার হওয়ার সুযোগে লেবু মহন্তকে ভয়ভীতি দেখায়। এক পর্যায়ে দুর্গাপূজার সময় লেবু ডিবি পুলিশের সোর্স পরিচয়ে মহন্তকে ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের কিশামত হলদিয়া গ্রামের একটি চাতালে ডেকে নেয়। সেখানে চাতাল মালিকের ছেলে মিজানসহ কয়েকজন মিলে টাকা দাবি ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। ভয়ে মহন্ত তাদের ৪ হাজার টাকা দিয়ে রক্ষা পায় বলে জানা গেছে।
পরে ঘটনাটি জানাজানি হলে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। শুক্রবার (১০ অক্টোবর) সন্ধ্যায় পাতিল্লাকুড়া বাজারে মহন্তের লোকজন লেবুকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে প্রতারণার কথা স্বীকার করে। পরে স্থানীয় একজন জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দিলে পুলিশ এসে দুজনকেই থানায় নিয়ে যায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আটকের পর রাতে পুলিশ কোনো মামলা না নিয়ে চুপিসারে তাদের ছেড়ে দেয়। আপোষ, মুচলেকা বা কার জিম্মায় মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তাও অজানা। সেদিন থানায় উপস্থিত একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ‘আমরা উভয়পক্ষের লোকজনসহ ওসি তাজ উদ্দিনের রুমে ছিলাম। উভয়ের কাছে ঘটনা জেনে তিনি সবাইকে বাড়ি যেতে বলেন এবং জানান, এদের মামলা দিয়ে সকালে কোর্টে পাঠানো হবে। কিন্তু পরে মধ্যরাতে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।’
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার মধ্যস্থতায় ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজনের দাবি, থানা থেকে মুক্তির বিনিময়ে উভয় পক্ষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে থানার একাংশে ভাগ হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ঘটনার রাতে থানায় নলডাঙ্গা ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামী সভাপতি মো. আল আমিন ও সেক্রেটারি মো. শফিউল আলমকে দেখা যায়।
জানতে চাইলে মুঠফোনে আল আমিন বলেন, ‘অন্য কাজে থানায় গিয়ে ঘটনা জানতে পারি। তারা দুজনই জুয়ার সঙ্গে জড়িত এবং ভুয়া ডিবি পরিচয়ে টাকা আদায়ের কথা স্বীকার করেছে। তাদের থানায় রেখে বাড়ি চলে আসি। এরপর রাতে কী হয়েছে জানি না।'
অন্যদিকে শফিউল ইসলাম থানায় যাওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, 'আটক লেবু স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তবে পুলিশ কেন তাদের মামলা না দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে, তা জানা নেই।’
এদিকে, এ ঘটনায় তথ্য জানতে থানায় গেলে পুলিশ নীরবতা ও গড়িমসি করে। এক পুলিশ সদস্য জানান, বিষয়টি সেদিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার জানা থাকতে পারে। পরে ডিউটি ও বিট অফিসার এসআই আবু তালেব বলেন, ‘আমি নতুন দায়িত্বে, সেদিনের অভিযোগ বা আটকের বিষয়ে কিছু জানি না।’
পরে বিষয়টি জানতে চাইলে মুঠফোনে ওসি (তদন্ত) মাহামুদুল হাসান বলেন, ‘ওসি স্যার ছুটিতে আছেন। সেদিনের বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। তিনি ৩ দিনের ছুটিতে গেছেন এবং ১৫ অক্টোবর আসবেন।’
সোমবার সন্ধ্যায় আবারও বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আপনাদের মাধ্যমে বিষয়টি জানার পর সেকেন্ড অফিসারকে ডেকে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। বিস্তারিত ওসি স্যার ছুটি থেকে ফিরলে জানা যাবে।' তিনি স্বীকার করে বলেন, 'একজনের মোবাইল জব্দের ঘটনা জেনেছি। ইতোমধ্যে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে ঘটনায় জড়িত এএসআই এরশাদ আলীকে ক্লোজ করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে।'
তবে সাদুল্লাপুর থানার ওসি তাজ উদ্দিন খন্দকার ছুটিতে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এরআগে, গত বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) রাতে মন্দুয়ার গ্রামের ক্যাসিনো সিন্ডিকেটের সদস্য ফিরোজ মিয়াকে হাতেনাতে ধরেও আটক না করে শুধু তার মোবাইল জব্দ করে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে, পরে ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে থানায় ডেকে মোবাইলটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় মধ্যস্থকারী স্থানীয় দুই ক্যাসিনো ডিলার জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে।
অভিযুক্ত এএসআই এরশাদ আলী মুঠফোনে বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘ওই যুবককে আটক না করা আমার ভুল ছিল। মোবাইলটি লক থাকায় ওসি স্যারের কাছে দিয়েছি; তিনি ফেরত দিয়েছেন কি না, জানি না।’
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার নিশাত এ্যাঞ্জেলাকে জানানো হলে, তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মহন্ত ও লেবুকে ছাড়ার ঘটনা নতুন নয়—এর আগেও সাদুল্লাপুর থানার পুলিশের বিরুদ্ধে রফাদফা ও অর্থ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনায় থানা পুলিশের ভুমিকা নিয়ে এলাকার মানুষের মাঝে ক্ষোভ ও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, থানার একাংশের পুলিশ দীর্ঘদিন ধরে অনলাইন জুয়া, মাদক ও সুদ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় এবং আটক ব্যক্তিদের ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা শোনা যাচ্ছে, যা রাজনৈতিক প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়।
সচেতন মহল বলছেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা উচিত। তারা দ্রুত তদন্ত করে জড়িত পুলিশ সদস্য এবং মধ্যস্থকারী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
What's Your Reaction?






