রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ হারালেন রাজবাড়ীর নজরুল ইসলাম

Oct 9, 2025 - 14:33
 0  5
রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ হারালেন রাজবাড়ীর নজরুল ইসলাম
ছবি : সংগৃহীত

রাশিয়ায় গিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের চর রামকান্তপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য নজরুল ইসলাম (৪৭)। নিখোঁজ থাকার দীর্ঘ সাত মাস পর গত বুধবার (৮ অক্টোবর) বিকেলে তার মৃত্যুর খবর আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় পরিবারকে। নিহত নজরুল ইসলাম স্থানীয় মৃত হাতেম আলী ফকিরের ছেলে।

পরিবারের সদস্যরা জানান, নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ল্যান্স কর্পোরাল পদে কর্মরত ছিলেন। ২০২০ সালে অবসরে যান তিনি। এর আগে ২০১৩ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেন কঙ্গোতে। অবসরের পর কিছুদিন বাড়িতে থাকলেও পরে বাঁধাই মালের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু ব্যবসায় বড় লোকসান গুনতে হয় তাকে।

আর্থিক সংকটে পড়লে স্থানীয় এক দালাল ফরিদ হোসেন তাকে রাশিয়ায় ‘শপিং মলে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরির’ প্রলোভন দেখান। পরিবারের আপত্তি উপেক্ষা করে নজরুল ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছানোর পর তাকে এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করা হয় এবং পরে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়।

প্রথমদিকে পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত ভিডিও কলে যোগাযোগ রাখতেন নজরুল। স্ত্রী আইরিন আক্তারকে এক সময় তিনি বলেন, ‘এখান থেকে ফেরা আমার পক্ষে সম্ভব না। যদি ফোন বন্ধ দেখায়, ধরে নিও আমি আর নেই।’

পরিবারের সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয় ৩০ এপ্রিল। সেদিন তিনি জানান, ব্যাংকে টাকা পাঠাতে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করে বলেন, ‘টাকা পাঠানো হলো না, দ্রুত যেতে হচ্ছে। যদি ফোন বন্ধ থাকে, ধরে নিও আমি বেঁচে নেই।’ -এরপর থেকে তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি।

দীর্ঘ সাত মাস ধরে পরিবারের সদস্যরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করলেও কোনো সাড়া পাননি। অবশেষে গতকাল বুধবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফোনে তার মৃত্যুর খবর জানানো হয়।

নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী আইরিন আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী অবসরের পর বাড়িতেই থাকতেন। ব্যবসায় লোকসানের পর স্থানীয় দালাল ফরিদের মাধ্যমে রাশিয়ায় যায়। আমি তাকে বহুবার নিষেধ করেছিলাম, বলেছিলাম- সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে থাকব। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, রাশিয়ায় ভালো বেতনের নিরাপত্তাকর্মীর চাকরি আছে, সংসারের অবস্থা ভালো হবে। এখন চার মেয়েকে নিয়ে আমি কীভাবে বাঁচব, কিছুই বুঝতে পারছি না।’

নজরুল ইসলামের বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট রহিম বলেন, ‘ফরিদ নামের দালাল আমার ভাইকে প্রলুব্ধ করে রাশিয়ায় পাঠিয়েছে। আমরা বহু জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। ফরিদ সব সময় বলত, ‘ও বেঁচে আছে, নেটওয়ার্ক না থাকায় যোগাযোগ করতে পারছে না।’ এখন শুনলাম, ও আর বেঁচে নেই। সরকার যেন অন্তত লাশটা দেশে আনার ব্যবস্থা করে।’

অভিযুক্ত দালাল ফরিদ হোসেন বলেন, ‘আমি নজরুলকে রাশিয়ায় পাঠাইনি। সে গেছে ‘বিকন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’ নামক একটি এজেন্সির মাধ্যমে। আমি শুধু যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি। সে সব জেনে-বুঝেই গিয়েছিল, রাশিয়ান সেনাবাহিনীর লজিস্টিক হ্যান্ড হিসেবে কাজ করবে বলে জানত। এমনকি ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’-এ স্বাক্ষরও করেছে। গত রাতে শুনেছি, মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে নজরুল মারা গেছে। এখানে আমার দোষ দিয়ে লাভ কী?’

রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মারিয়া হক বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এদিকে নিহত নজরুল ইসলাম রেখে গেছেন চার কন্যাসন্তান। তাদের মধ্যে বড় মেয়ে এ বছর রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, দ্বিতীয় মেয়ে পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে এবং ছোট দুই মেয়ের বয়স মাত্র ৬ ও ৫ বছর। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে স্তব্ধ ও দিশেহারা হয়ে পড়েছে নজরুলের পরিবার।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow