জন্ম-মৃত্যু সনদ জালিয়াতিসহ গুরুতর অভিযোগ ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে

Sep 12, 2025 - 23:00
 0  3
জন্ম-মৃত্যু সনদ জালিয়াতিসহ গুরুতর অভিযোগ ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম।

গাইবান্ধা প্রতিনিধি

গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার ৩নং দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনে চাঞ্চল্যকর জালিয়াতি-অনিয়মের ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের টার্গেট পূরণের নামে একই ব্যক্তিকে একাধিকবার পিতা-মাতা দেখিয়ে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ ইস্যুর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

ফলে দুই মাস আগে চেয়ারম্যান ও জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধক মো. জাহাঙ্গীর আলমের ক্ষমতা প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে তখনকার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মিজানুর রহমান আকন্দের নিবন্ধন সহকারীর দায়িত্বও বাতিল হয়। মিজানুর বরিশাল ইউনিয়ন পরিষদে কর্মরত।

বর্তমানে এ ইউনিয়ন পরিষদে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্ব পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা আবু সালেহ মো. সালাহউদ্দিনকে দেওয়া হয়েছে। গত ১৩ জুলাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কাজী মোহাম্মদ অনিক ইসলাম এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেন। তবে এখনো তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অভিযুক্ত চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম ফ্যাসিস্ট দলের নেতা হিসেবে পরিচিত এবং তিনি দামোদরপুর ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক ছিলেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, তিনি বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এছাড়া ফ্যাসিস্ট পুনর্বাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি চালানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, দামোদরপুর ইউনিয়নের অনলাইন জন্ম নিবন্ধন বহি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একই ব্যক্তিকে একাধিকবার পিতা-মাতা দেখিয়ে সনদ ইস্যু করা হয়েছে। যেমন, রুমি বেগমকে ১১টি এবং রবিউল হাসানকে ৯টি জন্ম সনদে যথাক্রমে মাতা ও পিতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এর আগে, ২০২৫ সালের ২৭ মে ভুয়া নিবন্ধনের বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিষয়টি। পরে পৃথক তদন্তে উঠে আসে ভয়াবহ তথ্য, ২০১৪ সালের ৩১ মে রুমি বেগম–বাদশা মিয়া দম্পতিকে পিতা-মাতা দেখিয়ে ৭টি এবং রুমি বেগম–বজলু মিয়া দম্পতিকে পিতা-মাতা দেখিয়ে ৪টি সনদ ইস্যু করা হয়।

এছাড়া ২০২৪ সালের ১৪ মে রবিউল হাসানকে পিতা দেখিয়ে ৯টি জন্ম নিবন্ধন করা হয়। এসব সনদ পরবর্তীতে তদন্তে ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে, যা জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০০৪-এর ২১(১) ও (৩) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

তদন্তে অভিযোগ প্রমাণের পর জরুরী তলব করলে চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম লিখিত জবাবে দাবি করেন, কম্পিউটার ব্যবহারে অজ্ঞ হওয়ায় তিনি নিজে ইউজার আইডি ব্যবহার করেননি। প্রশাসনিক কর্মকর্তা মিজানুর রহমান আকন্দ তাঁর আইডি ব্যবহার করে এসব সনদ তৈরি করেছেন। তবে মিজানুর রহমান লিখিতভাবে স্বীকার করেন, টার্গেট পূরণের জন্যই তিনি একই ব্যক্তিকে একাধিকবার পিতা-মাতা দেখিয়ে ভুয়া নিবন্ধন করেছেন।

এর আগে, গত ২৫ জুন রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় জেলা প্রশাসককে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়। পরে ১০ জুলাই জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় গত ১৩ জুলাই ইউএনও চেয়ারম্যান ও সহকারীর ক্ষমতা প্রত্যাহার করে আদেশ জারি করেন।

জানতে চাইলে নতুন দায়িত্ব পাওয়া আবু সালেহ মো. সালাহউদ্দিন বলেন, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। পূর্বে আরও কোনো অনিয়ম ছিল কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

শুধু জন্ম নিবন্ধন নয়, চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ভাতা ও অন্যান্য সুবিধার নামে অর্থ আদায়ের কথাও এখন স্থানীয়দের মুখে মুখে। এরই মধ্যে অনুসন্ধানে বিভিন্ন প্রকল্পসংক্রান্ত অভিযোগের অডিও-ভিডিসহ তথ্য-প্রমাণ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে খোদ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুল লতিফ ইউএনও বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগও জমা দিয়েছেন।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মুঠোফোনে চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'সব অভিযোগ মিথ্যা। আমার কোনো অনিয়ম নেই, ইনশাআল্লাহ। লতিফ গত ছয় মাস ধরে পরিষদে আসেন না। তিনি এসব মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।'

এ বিষয়ে ইউএনও কাজী মোহাম্মদ অনিক ইসলাম বলেন, 'চেয়ারম্যান ও সহকারীর জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধকের ক্ষমতা প্রত্যাহার করা হয়েছে। সম্প্রতি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আরও কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়গুলো নিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

উল্লেখ্য, চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।দামোদরপুর ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক থাকাকালে দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে নির্বাচন করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অন্য দলের নেতাদের সঙ্গে মেলামেশা করে অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন জাহাঙ্গীর। এতে এলাকায় ক্ষোভ ও ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে।

এলাকাবাসী বলছেন, জন্ম নিবন্ধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নথিতে ভুয়া তথ্য প্রবেশ করানো প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। তারা দ্রুত, সুষ্ঠ তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow